Saturday, October 4, 2025
HomeHeritageCultureBanglar Loksanskriti Gangatikuri Gramer Shiv Gajon বাংলার লোকসংস্কৃতি গঙ্গাটিকুড়ি গ্রামের শিব গাজন

Banglar Loksanskriti Gangatikuri Gramer Shiv Gajon বাংলার লোকসংস্কৃতি গঙ্গাটিকুড়ি গ্রামের শিব গাজন

Banglar Loksanskriti Gangatikuri Gramer Shiv Gajon

আমরা দুটি ভাই শিবের গাজন গাই, ঠাকুমা গেছে গয়া কাশি ডুগডুগি বাজাই’, ছোটবেলার এই ছড়া চৈত্র মাসের গাজনের (Banglar Loksanskriti Gangatikuri Gramer Shiv Gajon) মধ্যে দিয়ে মনে করিয়ে দেয় , বাঙালীর জীবনে বারো মাসে তেরো পার্বন । শেষে আসে চৈত্র । চৈত্রে গ্রাম্য কন্ঠ সুর তোলে – “ বাবা তারকনাথের চরণে সেবা লাগে -” শিব দেবাদিদেব , আদি যোগী । সভ্যতা, সংস্কার ,আচার ,ব্যবহার, সুর ,ছন্দে সৃষ্টি দেবাদিদেব মহাদেব থেকে । এক দিকে তিনি মহাপ্রলয়ের দেবতা, অপর দিকে তিনি কল্যাণসুন্দর। শিব প্রাগার্য সংস্কৃতির দেবতা। শিবপত্নী উমাপার্বতী। বেদান্তে এই আদি দেবতা পরমেশ্বরের উদ্দেশে বলা হয়েছে –

তমীশ্বরাণাং পরমং মহেশ্বরং তং দেবতানাং পরমঞ্চ দৈবতম/”

রাঢ়দেশের গাজন বললেই প্রাণের ভেতরে একটা আলাদা জোয়ার আসে। পূর্ব বর্ধমান জেলার কেতুগ্রাম থানার গঙ্গাটিকুরি গ্রাম ও তৎসংলগ্ন অঞ্চলে গাজন উৎসব বেশ ধূমধাম করে উৎযাপন করা হয়। গাজন শিবের পুজোকে কেন্দ্র করে একটি উৎসব হওয়ায়, গাজন’ শব্দের উৎপত্তি সম্পর্কে বলা হয়ে থাকে গর্জন শব্দ থেকেই গাজন শব্দের উৎপত্তি লাভ ঘটেছে। বলা হয়, মহাদেব বা শিবের নামে সন্ন্যাসীদের উচ্চস্বরে জয়ধ্বনি গর্জনের মতো শোনায়, তাই এই অর্থই ক্রমে গাজন উৎসবের রূপ নিয়েছে। অন্য একটি মতে ‘গাঁবা গাঁগঞ্জ অর্থে গ্রাম, ‘জন’ অর্থে জনগণ, অর্থাৎ গ্রামের জনসাধারণের মধ্যে প্রচলিত উৎসব হল গাজন। তবে যে মতই বলিষ্ঠ হোক না কেন, রাঢ় বাংলার অন্যতম প্রধান উৎসব গাজন, আর সেই গাজনকে কেন্দ্র করে এমন উৎসাহ উদ্দীপনা সারা রাঢ়দেশে দেখা যায়। পূর্ব বর্ধমানের গঙ্গাটিকুরি গ্রামটি গাজন উৎসবের অবস্থানগত কেন্দ্র হিসাবে বিখ্যাত, যেমন গাজনের জলসন্ন্যাসএর বিশেষ দিনের জন্য বিখ্যাত উদ্ধারণপুর ঘাট।

Banglar Loksanskriti Gangatikuri Gramer Shiv Gajon
Banglar Loksanskriti Gangatikuri Gramer Shiv Gajon

মূলত একমাস ধরে সন্ন্যাসীদের উপবাস ও অন্যান্য ব্রত চলে, তবে অল্প কয়েকজন মাসিক সন্ন্যাসী এই ব্রত পালন করে ও তাদের সাথে একজন মূল সন্ন্যাসী থাকে এবং বাকি সন্ন্যাসীদের দ্বারা উৎসবের শেষ চারদিন অর্থাৎ বাংলা সালের চৈত্রের শেষ চার/ পাঁচ দিন জাঁকজমক করে পালন করা হয় গাজন উৎসব। এই শেষ চারদিনের চারদিনের চারটি নাম আছে, যেমন ফুলভাঙা দিন, জলসন্ন্যাস দিন, হোম পুজোর দিন এবং চড়ক সংক্রান্তি।

Banglar Loksanskriti Shiv Gajon: বাংলার লোকসংস্কৃতি শিব গাজন

ফুলভাঙা দিন (Banglar Loksanskriti Gangatikuri Gramer Shiv Gajon)

গঙ্গাটিকুরিতে ফুলভাঙা দিন নাম হলেও পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলিতে একে খাজুরভাঙা দিন বলে ডাকা হয়। এই দিনে সকাল থেকে সন্ন্যাসীরা উপোষ করে থাকে এবং সকালে গঙ্গায় স্নান করে আসে। দুপুরে ১২টার দিকে পূজার পর প্রধান পুরোহিত সন্ন্যাসীদের গলায় শৈব পৈতে, ডান হাতে বেতের বালা এবং বিকালে ফুলভাজার আগে পুরোহিত সন্ন্যাসীদের লতাপাতার উত্তরীয় পরিয়ে দেয়। তারা সেদিন বিকালে গ্রামের বিভিন্ন ফলের গাছের ডাল ভেঙে বেড়ায়। ফুল ভাঙতে যাওয়ার আগে তারা সারা শরীরে চন্দনের ফোঁটা দিয়ে রাঙিয়ে দেয়। হাতে পরে আকন্দ ফুলের বালা ও মাথায় এবং গলায় পরে আকন্দ ফুলের মালা। তারা মুখে জয়ধ্বনি দিয়ে গান করেও সাঁতুলে, ফুল ভাঙতে যাবো মোরা…’। বিকালে গ্রামের বিভিন্ন ফলের গাছের ডাল ভেঙে বেড়ায়, এই ফলের গাছ ডাল ভাঙাকে মানুষ ভাবে তাদের আরও শস্যশ্যামলা হবে উদ্ভিদ সব, ফলের গাছে আরও বেশি ফল উৎপন্ন হবে। হয়তো ফুল ভাঙা নামটি সেই অর্থে প্রজনন বা নবমুকুলের সাথে যুক্ত । এই ফুল ভাঙার দিন সন্ধ্যা থেকে সারারাতই রাঢ়দেশীয় সমস্ত শিব মন্দিরে ধুমধাম করে বোলান গান অনুষ্ঠিত হয়, এই বোলন গুলির মধ্যে দাঁড় বোলান, পালা বোলান প্রভৃতি বেশি হয় এবং পরের দিন জলসন্ন্যাসের দিন শ্মশান বোলান বেশি দেখা যায়। এইভাবে রাত গড়িয়ে ভোররাতে শুরু হয় ঢেলাভাঙা নামক বিচিত্র আচার, যা সন্ন্যাসীরা পালন করে এবং তারপরই বিখ্যাত আচার গাজনসিদ্ধি ‘, এই আচারে একশ আট শিবকে ভারতীয় যোগসাধনার সাথে শ্রদ্ধা জানানো হয়। এই সিদ্ধি আচারে দৈহিকভাবে ক্ষমতাশালী সন্ন্যাসী ছাড়া বাকিরা অংশগ্রহণ করে না।

Banglar Loksanskriti Gangatikuri Gramer Shiv Gajon
Banglar Loksanskriti Gangatikuri Gramer Shiv Gajon

. জলসন্ন্যাস দিন :ফুলভাঙার রাত ঘুমেজাগরণে পার হওয়ায় পর পরের দিন সারাদিন নির্জলা উপোসী থেকে বিকালের পর শিবলিঙ্গ ও শিবের দোলকে স্নান করাতে গঙ্গায় যায় সমস্ত সন্ন্যাসীরা। গঙ্গায় স্নান করে উপোষ ভঙ্গ করে তারা বাড়ি ফিরে ফল ও গঙ্গা জল পান করে। সারাদিন নির্জলা উপোস থেকে গঙ্গাস্নানের পর জল গ্রহণ করতে হয় বলেই এই দিনের নাম জলসন্ন্যাস। এই দিনে স্নানযাত্রা এক বিচিত্র শোভাযাত্রার মতো আকার নেয়। সেদিন গঙ্গাটিকুরির উপর দিয়ে লক্ষাধিক মানুষ উদ্ধারণপুরে স্নানযাত্রা করে, এখানে যেমন সন্ন্যাসীরা অংশগ্রহণ করে, তেমনই হাজার সাধারণ মানুষ তাদের নিজের গ্রামের রংবেরংএর চাঁদোয়াতে ঢাকা শিবের দোলের সাথে গঙ্গা স্নানে যোগ দেয়। বলা হয়, এই বিশেষ দিনে গঙ্গা স্নানফেরত প্রতিটি মানুষকে ছোলা, গুড়, কুল, ফল ও জল খাওয়াতে হয়, তাই বিভিন্ন স্থানে বিনামূল্যে খাওয়ানো ব্যবস্থা করা হয় পথযাত্রীদের এবং সন্ন্যাসীদের জন্য গঙ্গা জল পান ও ফলমূলাদির গ্রহণের ব্যবস্থা করা হয়। এই প্রসঙ্গে বলি, সুদূর বীরভূম বা মুর্শিদাবাদের সন্ন্যাসীরা ব্যতীত স্থানীয় সন্ন্যাসীরা শুধুই গঙ্গা জল পান করে, ফলমূলাদি গ্রহণ করে না। এখন বেশিরভাগ দূর গ্রামের দোল সন্ন্যাসীদের নিয়ে ট্রাক্টরে বা ছোটোহাতি গাড়িতে আসে কিন্তু আগে প্রতিটি গ্রামের দোলই সন্ন্যাসীদের নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে উদ্ধারণপুর যেতো। হয়তো বীরভূমের কোনও প্রত্যন্ত গ্রামের দোল ভোররাতে বের হয়ে গঙ্গা স্নান করে আবার বাড়ি পৌঁছাতে তাদের রাত হয়ে যেতো। প্রতিবছরই এইদিনে নিরোল, পাঁচুন্দি, গঙ্গাটিকুরি প্রভৃতি বড়ো গ্রামগুলির দোলের সাথে কয়েকশো সন্ন্যাসী এবং হাজারের বেশি মানুষ উদ্ধারণপুরে গঙ্গাস্নানে অংশগ্রহণ করে। এইদিন প্রতিটি দোলই উদ্ধারণপুরের আগে নৈহাটির কালারুদ্ধতলা হয়ে গঙ্গাস্নানে যায়, কালারুদ্ধ ঠাকুরের এই স্থানটিকে এই অঞ্চলের শাক্ত ও বৈষ্ণবের একটি মিলনক্ষেত্র হিসাবে বিবেচনা করা হয়।

. হোম পুজোর দিন :- গাজনের বিশেষ হোমের পুজো, নীলপুজো এবং বলিদান এইদিনেই সম্পন্ন হয়। এই দিনেই দুপুরে বাণেশ্বর বা প্রতীক ঈশ্বরকে নিয়ে গ্রাম পরিক্রমা হয়। এইদিনটিতেও সন্ধ্যা থেকে সারারাত বোলন গানের আসর বসে। এখানে উল্লেখ্য, ফুলভাঙার দিন বাইরের গ্রামের বোলান দলের গান বেশি হয় গাজনতলাতে কিন্তু হোমপুজোর দিনই শুধুই গ্রামের বোলান দলের গান অনুষ্ঠিত হয় জাঁকজমকের সাথে।

Banglar Loksanskriti Gangatikuri Gramer Shiv Gajon
Banglar Loksanskriti Gangatikuri Gramer Shiv Gajon

. চরক সংক্রান্তি :- বছরের শেষদিন তথা চৈত্র মাসের শেষদিন তথা গাজনের শেষদিন। এদিন ভোরবেলাতে শিবতলা থেকে একটু দূরে ঈশানী নদীর উপর বিভিন্ন জায়গা থেকে জড়ো করা ডাল এবং ফুলভাঙার দিন ভাঙা ডালগুলোতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়, তারপর সন্ন্যাসীরা তার উপর দিয়ে সাত বার প্রদক্ষিণ করে, আগুনের উপর সন্ন্যাসীদের এই হাঁটা দেখতে ভোর ৪ টে থেকে মানুষের ঢল নামে। এদিন হল যেসব সন্ন্যাসীরা মাসভর বা চারদিনের ব্রত পালন করছিলেন তাদের সেদিনই শেষদিন ব্রতপালনের। এইদিন বিকালে রঙিন চাঁদোয়াতে মোড়া শিবের দোলটি নিয়ে সারাগ্রাম প্রদক্ষিণ হয়, যেটি এর আগে একমাত্র ফুলভাঙার দিনই পর গঙ্গা স্নানের আগে। চরক সংক্রান্তির দিন বিকালে গ্রাম প্রদক্ষিণের পর যেখানে চরকের মেলা বসে সেই ঈশানী নদীর তীরে আম বাগানে শিবের দোলটিকে রাখা হয়। তবে চরক উপলক্ষে গঙ্গাটিকুরিতে বা আশেপাশে গ্রামে বর্শি দিয়ে মানুষ গেঁথে ঘোরানো হয় না। একমাত্র গঙ্গার ওপারে বল্লভপাড়া এবং কাটোয়ার পানুহাটে, এই দুই জায়গায় চরকের মেলাতে বর্শি দিতে মানুষ গেঁথে ঘোরানো হয়।

Bangiyo Aitihye Bhokti Dhara বঙ্গীয় ঐতিহ্যে ভক্তি ধারা

চোতক্ষ্যাপা:গাজনের সবচেয়ে আকর্ষণীয় চরিত্র হল এই চোতক্ষ্যাপারা। তাদের মুখের প্রচলিত বুলি গঙ্গা যদি মদ হতো আর হাতি যদি চাট হতো তবে খেয়ে সুখ হতো। গঙ্গাটিকুড়ি গ্রামের চোতক্ষ্যাপা গুগুলি মালার পরিহিত তিনকড়ি মাঝি, সেম্পেল হাজরা , সন্ন্যাসী হাজরা এদের ছাড়া গাজন অসম্পূর্ণ ।

উপরোক্ত পৌরাণিক বিশ্লেষণ, এবং গ্রামীণ সংস্কৃতি, মহাদেবের লৌকিক রূপ আলোচনা প্রেক্ষিতে আমরা বলতে পারি শিব ঠাকুর বাঙ্গালীদের অত্যন্ত আপন, অত্যন্ত প্রিয় এবং শ্রদ্ধার। বাঙ্গালী জাতি ও বাংলার উপর প্রভু মহেশ্বরের কৃপা দৃষ্টি সর্বদা বহাল থাকুক।

গাজন উৎসব

সম্পর্ক মণ্ডল ও পল্লব মণ্ডল

RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Most Popular

Recent Comments