দেবী সতী দক্ষ রাজার অমতে মহাদেবকে বিবাহ করেছিলেন। প্রতিশোধ নেওয়ার উদ্দেশে একটি যজ্ঞের আয়োজন করেছিলেন দক্ষ রাজা। যজ্ঞের আগুনে আত্মঘাতী হন সতী। ক্রোধে উন্মত্ত হয়ে ওঠেন মহাদেব। পৃথিবী ধ্বংস হওয়ার ভয়ে ভগবান বিষ্ণু প্রলয় থামাতে, সুদর্শন চক্র পাঠিয়ে দেন। দেবীর দেহ ৫১টি খণ্ডে বিভক্ত হয়ে বিভিন্ন জায়গায় পড়ে। এই সব কটি জায়গাকে সতীপীঠ বলা হয়। সতীর ৫১ পীঠ হিন্দু ধর্মে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই জায়গাগুলি প্রত্যেক হিন্দুর কাছে পরম পবিত্রের জায়গা। বিভিন্ন জায়গা জুড়ে রয়েছে এই ৫১ পীঠ। ভারতবর্ষ–সহ বাংলাদেশ,পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কায় এই ৫১টি পীঠ অবস্থিত। অবিভক্ত বাংলায় ১৯ টি সতী পীঠ, যার মধ্যে আমাদের রাজ্য পশ্চিমবঙ্গে (Bangiyo Aitihye Bhokti Dhara) ১৪ টি শক্তি পীঠের এবং একটি সিদ্ধপীঠ তারাপীঠের অবস্থান এই জননী জন্মভূমি পশ্চিমবঙ্গে ।
কালীঘাট, কলকাতা
কালীক্ষেত্র কালীঘাট। উত্তরে দক্ষিণেশ্বর আর দক্ষিণে বহুলা বা বেহালা। মাঝে ধনুকের মতো বাঁকা অংশ কলকাতা। পীঠনির্নয় তন্ত্র অনুসারে কালীক্ষেত্র কলকাতার মাহাত্ম্য বারাণসীর সমতুল। সেই কলকাতার অভিভাবকরূপে কালীঘাটে বিরাজ করছেন মা দক্ষিণাকালী। সতীর একান্ন পীঠের অন্যতম। দেবী কালী , কলকাতা শহরের বুকে এই সতীপীঠকে আদি সতীপীঠ হিসেবে গণ্য করা হয়। বলা হয়, এখানে পড়েছিল দেবীর ডান পায়ের আঙুল। এখানে অধিষ্ঠিত দেবী হলেন দক্ষিণাকালী এবং ভৈরবের নাম নকুলেশ্বর। বলা হয়, বেহালা থেকে দুই যোজন ব্যাপী কালীক্ষেত্রের ৩ কোণায় অবস্থান করছেন ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বর। তাঁর মাঝেই মহাকালীর অবস্থান। এখানে ভৈরবী, বগলা, বিদ্যা, মাতঙ্গী, কমলা, ব্রাহ্মী, মহেশ্বরী ও চণ্ডী সর্বদা বিরাজ করছেন। তাই এই জায়গা কাশী বা বারাণসীর মতোই মহা পূণ্যভূমি। মন্দিরের উপরে রয়েছে ৩ টি কলস , ১ টি ত্রিশূল ও ১ টি ত্রিকোণা ধাতব পতাকা যাতে ‘ॐ‘ লেখা রয়েছে। এটি তৈরি করতে আট বছর সময় লেগেছিল এবং তাতে খরচ হয়েছিল ৩০ হাজার টাকা। কালীঘাটের মন্দির কে তৈরি করলেন, কার আমলে ছড়িয়ে পড়ল মায়ের মাহাত্ম্য ? এই প্রশ্ন ঘিরে নানা বিশ্বাস, নানা ইতিহাস, নানা কিংবদন্তি। তার মধ্যে একটি প্রচলিত কাহিনী হল, আত্মারাম ব্রহ্মচারী নামে এক মাতৃসাধক কালীক্ষেত্রে দেবীর কঠোর তপস্যা করছিলেন। আত্মারাম একদিন রাতে দেবীর কণ্ঠস্বর শুনতে পান। তাঁকে বলা হয়, তিনি যে বেদীতে বসে তপস্যা করছিলেন, সেটি ব্রহ্ম বেদী। অর্থাৎ একসময় ব্রহ্মা ওই বেদীতে বসে তপস্যা করেছিলেন। তাঁকে আরও নির্দেশ দেওয়া হয়, নীলগিরি পর্বতে ব্রহ্মানন্দ গিরি নামে এক সাধক আছেন, তাঁর কাছে যে শিলাস্তম্ভ আছে, সেটিকে ব্রহ্মবেদীতে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। কালীয় কুণ্ডের ভীতরেই যে সতীর পায়ের চার আঙুল রয়েছে, তাও জানায় ওই দৈব কণ্ঠ। পরে আত্মারাম নীলগিরি পর্বতে গিয়ে ব্রহ্মানন্দ গিরিকে খুঁজে পান। এবং শোনা যায়, কোনও এক দৈবী শক্তি বলে ১২ হাত লম্বা ও ২ হাত চওড়া ওই শিলা দিয়ে আদিগঙ্গার তীরে কালীক্ষেত্রে এসে ওঠেন। কথিত আছে, স্বয়ং বিশ্বকর্মা সেই সময় উপস্থিত হয়ে ওই শিলাকে ব্রহ্মবেদীতে স্থাপন করেন এবং মাতৃরূপ দেন। ত্রিনয়না মূর্তি চতুর্ভূজ উপরের বাম হাতে খড়গ, নীচের বাম হাতে নরমুণ্ড। ডানদিকের উপরের হাতে বর ও নিচের হাতে অভয় মুদ্রা। তখন কিন্তু সতীর চার আঙুলের সন্ধান পাননি কেউই। পরবর্তীতে আত্মারামই জ্যোতি দ্বারা সঙ্কেত পেয়ে কালীয় হ্রদে খুঁজে পান সতীর প্রস্তুরীভূত ডান পায়ের চার আঙুল। তখন তা জল থেকে তুলে এনে মাকালীর বেদীর নিচে স্থাপন করা হয়। সেই দিনটা ছিল স্নানযাত্রা। আজও সেই বিশ্বাস থেকে প্রতিবছর ওই দিন সকাল থেকে মন্দির বন্ধ থাকে। বয়ঃজ্যেষ্ঠ সেবায়েতরা চোখে কাপড় বেঁধে সতীর সেই চরণাঙ্গুলি বের করে তাঁকে যথাবিহিত স্নান ও পুজো করেন। ১৮০৯ সালে বড়িশার সাবর্ণ জমিদার শিবদাস চৌধুরী, তাঁর পুত্র রামলাল ও ভ্রাতুষ্পুত্র লক্ষ্মীকান্তের উদ্দোগে আদিগঙ্গার তীরে বর্তমান মন্দিরটি নির্মিত হয়েছে। পরবর্তীকালে মন্দিরের কিছু পোড়ামাটির কাজ নষ্ট হয়ে গেলে সন্তোষ রায়চৌধুরী সেগুলি সংস্কার করেন। বর্তমান এই মন্দিরটি নব্বই ফুট উঁচু। এটি নির্মাণ করতে আট বছর সময় লেগেছিল এবং খরচ হয়েছিল ৩০,০০০ টাকা। মন্দির সংলগ্ন জমিটির মোট আয়তন ১ বিঘে ১১ কাঠা ৩ ছটাক, বঙ্গীয় আটচালা স্থাপত্য শৈলীতে নির্মিত মূল মন্দিরটির আয়তন অবশ্য মাত্র ৮ কাঠা। মূল মন্দির সংলগ্ন অনেকগুলি ছোটো ছোটো মন্দিরে রাধাকৃষ্ণ, শিব প্রভৃতি দেবতা পূজিত হন।
Banglar Loksanskriti Shiv Gajon: বাংলার লোকসংস্কৃতি শিব গাজন
কালীঘাট, প্রাচীনকালে এই স্থানটি কালীক্ষেত্র নামে পরিচিত ছিল । অনেকেই শহরের নামের উৎপত্তি মন্দিরের সাথে সম্পর্কিত বলে মনে করেন। নামটির উৎপত্তি সম্পর্কে কোনও নথিভুক্ত প্রমাণ না থাকায় বিশেষজ্ঞদের মতামত ভিন্ন। সুতানুটি, গোবিন্দপুর এবং কালিকাটা , কলকাতা বা কলকাতা (শহরের ঔপনিবেশিক নামকরণ) কালিকাটা গ্রামের নাম থেকে উদ্ভূত হয়েছে । গ্রামের নাম কালীক্ষেত্র থেকে উদ্ভূত হতে পারে অথবা গ্রামের দক্ষিণ সীমানা তৈরিকারী খালের জন্য স্থানীয় বাংলা শব্দ থেকে উদ্ভূত হতে পারে। খাল ‘খাল‘ নামে পরিচিত এবং খননকে ‘কাটা‘ বলা হয়। দুটির মিলনের ফলে নামকরণ হতে পারে। কালীঘাটের আসল খ্যাতি যে দেবীর জন্য, সে কিন্তু বঙ্গ – উপাস্যা শ্যামার মতো আদপেই নয়। কালীঘাটের কালীমূর্তি ভাস্কর্যের জন্যই আলাদা করে চোখ টেনে নেয়। বিরাট বড় টানা–টানা তিনটি চোখ, রক্তমাখা কপাল আর হাতকয়েক লৌল জিহ্বায় কালিকা বিরাজ করেন এই মন্দিরে। চতুর্ভূজা দেবীর এক হাতে অজ্ঞানতা – তমসা ছেদনকারী খড়্গ, অন্য হাতে অহংরূপী অসুরের ছিন্ন মুণ্ড – প্রবাদ মানলে অসুররাজ শুম্ভরমুণ্ড! বাকি দুই হাতে অভয়মুদ্রা ও বরমুদ্রা। শক্তিপীঠের নিয়ম মেনে দেবমন্দিরের অদূরেই নকুলেশ্বর শিবের আবাস। নকুলেশ্বর দর্শন না করলে প্রথামাফিক দেবীও প্রসন্ন হন না। কালীঘাট কালীমন্দিরের কষ্টিপাথরের কালীমূর্তিটি অভিনব রীতিতে নির্মিত । মূর্তিটির জিভ, দাঁত ও মুকুট সোনার। হাত ও মুণ্ডমালাটিও সোনার।

কালিকাদেবীর প্রণামমন্ত্র
ॐ করালবদনাং ঘোরাং
মুক্তকেশীং চতুর্ভুজাম্ ।
কালিকাং দক্ষিণাং দিব্যাং
মুণ্ডমালাবিভূষিতাম্ ।।
সদ্যশ্ছিন্নশিরঃ
খড়্গবামাধোর্ধকরাম্বুজাম্ ।
অভয়ং বরদঞ্চৈব
দক্ষিণোদ্ধার্ধপাণিকাম্ ।।
মহামেঘপ্রভাং শ্যামাং তথা চৈব
দিগম্বরীম্ ।
কন্ঠাবসক্তমুন্ডালী-
গলদ্রুধিরচর্চিতাম্ ।।
কর্ণাবতংসতানীতশ
বযুগ্মভয়ানকাম্ ।
ঘোরদংষ্ট্রাং করালাস্যাং
পীনোন্নতপয়োধরাং ।।
শবানাং করসংঘাতৈঃ কৃতকাঞ্চীং
হসন্মুখীম্ ।
সৃক্কদ্বয়গলদ্রক
্তধারাবিস্ফুরিতাননাম্ ।।
ঘোররাবাং মহারৌদ্রীং
শ্মশানালয়বাসিনীম্ ।
বালার্কমণ্ডলাকারলোচনত্রিতয়ান্বিতাম্ ।।
দস্তুরাং দক্ষিণব্যাপিমুক
্তালম্বীকচোচ্চয়াম্ ।
শবরূপমহাদেবহৃদয়োপরি
সংস্থিতাম্ ।
শিবাভির্ঘোররাবাভিশ্চচতুর্দিক্ষু
সমন্বিতাম্ ।
মহাকালেন চ সমং
বিপরীতরতাতুরাম্ ।।
সুখপ্রসন্নবদনাং
স্মেরাননসরোরুহাম্ ।
এবং সঞ্চিন্তয়েৎ কালীং
সর্বকাম– সমৃদ্ধিদাম্ ।।
“কে জানে রে কালী কেমন!
ষড়দর্শনে না পায় দর্শন।।“
কঙ্কালীতলা, বীরভূম
দেবী কংকালেশ্বরী, বীরভূম জেলার কোপাই নদীর ধারে অবস্থিত এই পীঠ। বলা হয়, এখানে পড়েছিল দেবীর কাঁকাল বা কোমরের অংশ।
কাঞ্চীদেশে পড়িল কাঁকলি অভিরাম
বেদগর্ভা দেবতা ভৈরব রুরু নাম।।”
অধিষ্ঠিত দেবীর নাম এখানে দেবগর্ভা এবং ভৈরব হলেন রুরু। কারও মতে দেবী এখানে রত্নাগর্ভি নামে অধিষ্ঠিতা।
“কাঞ্চীদেশে চ কঙ্কাল ভৈরবো রুরু নামকঃ
দেবতা দেবগর্ভাখ্যা।।”
অন্তিম সতীপীঠ বীরভূম জেলার বোলপুর থেকে ৯ কিলোমিটার দূরে কোপাই নদীর তীরে শক্তিপীঠ কঙ্কালীতলা। তন্ত্রচূড়ামণির মতে, এটি ২৮ নং সতীপীঠ। প্রাচীনকালে এই জায়গাটি কাঞ্চি নামে প্রসিদ্ধ ছিল। তন্ত্রচূড়ামনিতেও এই স্থানের উল্লেখ আছে। পীঠ নির্ণয়তন্ত্র অনুসারে এখানে সতীর অস্থি পড়েছিল, সেই কারণে এই পীঠের নাম হয় কঙ্কালীতলা। আবার ভারতচন্দ্রের অন্নদামঙ্গল কাব্যগ্রন্থে অনুসারে এখানে সতীর কটিদেশ বা কোমরের অংশ পতিত হয়েছিল। এখানকার প্রধান আকর্ষণ হলো দেবীর মন্দির সংলগ্ন একটি কুণ্ড। কুণ্ডের মধ্যে কয়েকটি প্রস্থর খণ্ড আছে, যেগুলিকে সাধকরা দেবীর দেহের অংশ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন, মনে করা হয় দেবী সতীর খন্ডিত দেহাংশ এই কুন্ডেই নিমজ্জিত রয়েছে, এই প্রস্থর খণ্ডগুলি কুড়ি বছর অন্তর কুণ্ড থেকে তোলা হয়, পরে পূজার পর সেগুলিকে পুনরায় কুন্ডের জলে ডুবিয়ে দেওয়া হয়। কথিত আছে, কঙ্কালীতলার এই কুন্ডের সঙ্গে কাশীর মনিকর্ণিকা ঘাটের সরাসরি সংযোগ রয়েছে।ইতিহাসবিদ রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাংলার ইতিহাস বইতে দাবি করা হয়েছে, গৌড়বঙ্গের পালবংশের রাজা প্রথম মহীপালের রাজত্বে কাঞ্চিরাজ রাজেন্দ্রচোল বীরভূমের এই জায়গা দখল করে নিয়েছিলেন। শিবভক্ত কাঞ্চিরাজই কোপাই নদীর ধারে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন শিবমন্দির। যে কারণে এখানকার শিবলিঙ্গ কাঞ্চীশ্বর শিবলিঙ্গ নামে পরিচিত। শিবমন্দিরের পাশেই রয়েছে মহাশ্মশান ও পঞ্চবটী বন। কিছুদিন আগেও এখানে খোলা বেদীতেই দেবীর পুজো হত। এখন মন্দির তৈরি হলেও দেবীর কোনও মূর্তি নেই। রয়েছে শ্মশানকালীর বড় বাঁধানো ছবি। যাকে দেবী রূপে পুজো করা হয়। শোনা যায় যে বেদীর উপর বসে মাতৃবন্দনা করা হয়, তার নীচে পোঁতা রয়েছে ১০৮ নরমুন্ড। বাকি সতীপীঠ গুলির থেকে কঙ্কালীতলা বেশ কিছুটা আলাদা, এখানে দেবী সতী শ্মশানকালী রূপে পূজিতা হন, কোনো বিগ্রহ বা প্রস্তরে নয় বরং দেবী পূজিতা হন চিত্রপটে, শান্তিনিকেতনের এক বিখ্যাত চিত্রশিল্পী মুকুল দের অঙ্কিত ছবিই এখানে স্থাপন করা রয়েছে। শ্রীনারায়ণ কর্তৃক দেবী সতীর দেহ খন্ডিত হলে দেবীর বাকি দেহাংশ পতিত হয়ে সতীপীঠ সৃষ্টি হলেও দেবীর কাঞ্চিদেশ বা কোটিদেশ শিব তার হাত দিয়ে ধরে রেখে কাঁধে বহন করে চলেছিলেন, পরবর্তীতে নারায়ণের প্রভাবে শিবের চৈতন্যপ্রাপ্তি হলে তিনি নিজেই দেবীর এই খন্ড অবতরণ করান, দেবী বসুমতী এই ভীমভার বহন না করতে পারায় এই কুন্ডের সৃষ্টি হয়, সে কারণেই এই সতীপীঠকে অনেকেই অন্তিম সতীপীঠ বলে থাকেন।

• নলহাটি, বীরভূম – দেবী নলাটেশ্বরী , বীরভূমের নলহাটিতে অবস্থিত নলহাটেশ্বরী মন্দির। কেউ কেউ একে উপপীঠ বলে থাকেন।পীঠ নির্ণয়ের বর্ণনায় চতুশ্চত্বারিংশৎ শক্তিপীঠ হল নলহাটী। সেখানে বর্ণিত রয়েছে-
“নলাহাট্যাং নলাপাতো যোগীশো ভৈরবস্তথা।
তত্র সা কালিকা দেবী সর্বসিদ্ধি প্রদায়িকা।”
অর্থাৎ নলহাটীতে পড়েছে সতীর নলা। দেবীর নাম এখানে– কালী। ভৈরবের নাম– যোগীশ।
বলা হয়, এখানে সতীর গলার নলি বা কণ্ঠনালী পড়েছিল। এখানে দেবী শেফালিকা এবং ভৈরব যোগীশ নামে পরিচত। বলা হয় অনেক হাজার বছর আগে কামদেব প্রথম মায়ের স্বপ্নাদেশ পেয়েছিলেন। মায়ের আদেশে তিনি ব্রাহ্মণী নদীর তীরে ললাট পাহাড়ের নীচে যেখানে মায়ের কণ্ঠনালী পড়েছিল তার উপরেই দেবী নলাটেশ্বরীর মন্দির স্থাপন করেছিলেন। বলা হয় এখানে পাথরের টিলাতে সীতার চুল আঁচড়ানোর দাগ আছে ও কড়ি খেলার গর্ত আছে। লোকশ্রুতি অনুযায়ী রাম এখানে কিছুকাল অস্থায়ী ভাবে বসবাস করেছিলেন।জনশ্রুতি অনুযায়ী আনুমানিক পাঁচশ বছর আগে, ৯০০ সনের আষাঢ় মাসের শুক্ল নবমী তিথিতে পাইক পাড়া গ্রামের ব্যবসায়ী রামশরণ শর্মাকে মা স্বপ্ন দেন যে মা এখানে খোলা আকাশের নিচে রয়েছে, তাঁকে যেন প্রতিষ্ঠা করা হয়। মায়ের আদেশে রামশরণ শর্মা এই মন্দির প্রতিষ্টা করেছিলেন। পাহাড়ের মাঝে একটি গাছের নিচে মায়ের প্রস্তরীভূত দেহাংশটি পড়েছিল। সেখানেই মন্দির স্থাপিত হয়। এই মন্দির থেকে একটু দূরে যকধরী নদী বয়ে চলেছে, যার আসল নাম ব্রাহ্মণী নদী। বহুকাল আগে এই নদী নাকি মন্দিরের পাশ দিয়ে বয়ে যেত। একসময় এই জায়গা ঘন জঙ্গলে ও জন্তুতে পরিপূর্ণ ছিল। বলা হয় দিনের বেলাতেও এখানে সূর্যের আলো এসে পৌঁছত না। মায়ের পুজো করতে কেবল কাপালিক ও তন্ত্র সাধকরাই আসতেন এখানে। আর পুজো দিয়ে যেত তখনকার লুঠকারীরা। যারা কোথাও লুঠ করার আগে গোপন রাস্তা দিয়ে এসে মায়ের পুজো দিয়ে যেত। পরবর্তীকালে এর পরিস্থিতি বদলায়। পুরনো মন্দির সংস্কার করা হয়, আশপাশের জঙ্গল সাফ করা হয়। এই মন্দিরের ভৈরব ‘যোগীশ্বর‘ মন্দিরের ভিত খোঁড়ার সময় একটি পাথর পাওয়া যায় যেখানে নারায়ণের পদচিহ্ন খোদিত ছিল। এই পাথরটিকে মন্দিরে গাঁথাই করা আছে। এখানে মাটির নীচে কিছু জায়গার কথা বলা হয় যেখানে নাকি বর্গীরা (লুঠকারী) আশ্রয় নিত। এছাড়াও মন্দিরের চারদিকে কতকগুলি গর্তের সন্ধান পাওয়া গেছে। বলা হয়ে থাকে যেখানে মানুষ পড়ে গেলে আর তার সন্ধান পাওয়া যায় না। স্থানীয় বিশ্বাস অনুযায়ী এই গর্ত বা সুড়ঙ্গগুলো আসলে মন্দিরে যাবার পথ। মা নলাটেশ্বরী মন্দিরের জন্য রাণী ভবানী তিনশো পঁয়ষট্টি বিঘা জমি দান করেন। এখানে মায়ের বাগান আর একটা বাবার বাগান ছিল। মায়ের পুজোর জন্য রাণীমা সব ব্যবস্থাই করেছিলেন।
মা এখানে ত্রিনয়নী ও তার জিহ্বাটি সোনার। মন্দিরের অভ্যন্তরে দেবীর দেহাংশ (প্রস্তরীভূত) রক্ষিত আছে। প্রত্যেক দিন দেবীকে স্নান করিয়ে মঙ্গলারতি করার পূর্বে দেবীর প্রস্তরীভূত অঙ্গ ভক্তদের দর্শন করানোর ব্যবস্থা থাকে। এখানে নারায়ণের পদচিহ্ন অঙ্কিত যে শিলাটি মন্দিরে গাঁথা আছে আগে তাকে প্রণাম জানিয়ে তারপরতারপর দেবীর পূজা করা হয়ে থাকে। প্রত্যহ দেবীকে অন্নভোগ প্রদান করা হয়ে থাকে।
এখানে দুর্গাপুজোর সময় মাকে দুর্গারূপে ও কালীপুজোয় মাকে বিশেষ পুজোর ব্যবস্থা থাকে। বিশেষ বিশেষ অমাবস্যা তিথিতে মন্দিরে হোমযজ্ঞের ব্যাবস্থা থাকে। তবে বিশেষ উৎসবের মধ্যে শিবরাত্রিতে দেবী মন্দির ও ভৈরব শিবের মন্দিরে হলুদ সুতো দিয়ে বেঁধে যোগসূত্র স্থাপন করা হয়।
দেবী নন্দিকেশ্বরী
সাঁইথিয়া, বীরভূম
এই সতীপীঠের মন্দিরটি বীরভূমের সাঁইথিয়ার কাছে। কথিত আছে, এখানে পড়েছিল সতীর গলার হাড়। অধিষ্ঠিত দেবী এখানে নন্দিনী এবং ভৈরব নন্দিকেশ্বর।
বীরভূম জেলাতে অবস্থান করছে মায়ের পাঁচটি সতীপীঠ।
এই সাঁইথিয়ার আগে নাম ছিল নন্দীপুর। তন্ত্রচূড়ামণি গ্ৰন্থে নন্দিকেশ্বরী মন্দির শক্তিপীঠকে মূল পীঠ রূপে বর্ণনা করা হয়েছে। এই গ্রন্থে নন্দিকেশ্বরী মন্দিরকে পঞ্চাশতম পীঠ হিসাবে বর্ণিত হয়েছে। আবার “পীঠনির্ণয়তন্ত্র” গ্ৰন্থে এটিকে ঊনপঞ্চাশতম সতীপীঠ বলা হয়েছে। ভারতীয় উপমহাদেশের বিখ্যাত শক্তিপীঠের একটি হল দেবী নন্দিকেশ্বরী মন্দির মন্দির। দেবীর অপর নাম নন্দিনী। পীঠনির্ণয়তন্ত্রেই দেবী নন্দিনীকে “মহাদেবী” রূপে বর্ণনা করা হয়েছে এবং লেখা আছে এই নন্দীপুরে দেবীর গলার হার পড়েছিল। এখানে দেবীর ভৈরবের নাম “দেব নন্দীকেশ্বর“।
“হার পাতো নন্দিপুরে ভৈরব নন্দীকেশ্বর
নন্দিনী সা মহাদেবী তন্ত্র সিদ্ধি ভবাপ্নুরাত্“….
অন্যদিকে পীঠমালাতন্ত্র মতে দক্ষযজ্ঞের পর দেবীর কণ্ঠহাড় নাকি এখানে পড়েছিল। সেই গ্ৰন্থে রয়েছে
“হাড় পাতো নন্দীপুরে ভৈরব নন্দীকেশ্বর
নন্দিনী সা মহাদেবী তন্ত্র সিদ্ধির্ণসংশয় “….
স্বয়ং বামদেব, বামাক্ষ্যাপা নামে যিনি অধিক পরিচিত, এই নন্দিকেশ্বরী মন্দির পীঠে সাধনা করে সিদ্ধি অর্জন করেছিলেন। জনশ্রুতি, বামদেব যখন তারাপীঠে সাধনা করছিলেন তখন দেবী নন্দিনী তাকে স্বপ্নে দেখা দিয়ে বলেন তাঁর পুজো করলে তবেই সিদ্ধিলাভ করতে পারবেন বামাক্ষ্যাপা। তারপরই বামদেব এখানে এসে পুজো করেন।
ময়ূরাক্ষী নদীর কোলে এই মন্দির। এক বিশাল বটগাছ ছাতার মত ঘিরে রেখেছে নন্দিকেশ্বরী মন্দির মন্দির প্রাঙ্গনটিকে। কথিত, এই বটগাছের নীচেই দেবী নন্দিকেশ্বরী মন্দিরর অবস্থান।দেবীর নামটি ‘নন্দী‘ থেকে এসেছে। শিবের বাহন, অনুসরণকারী নন্দী এবং তার ঈশ্বরী মানে আরাধ্যা দেবী। মন্দিরের মধ্যে একটি উঁচু বেদীর উপর বিশাল ত্রিভুজাকৃতি পাথরখণ্ড। এই প্রস্তরখণ্ডটিতে তেল সিঁদুর মাখানোর ফলে শিলাটি লোহিত বর্ণ ধারণ করেছে।
তার গায়ে রূপার চোখ নাক মুখ বসিয়ে দেবীর মূর্তির রূপ দেওয়া। বটবৃক্ষের তলে কোটরেই বিরাজ করছেন দেবীর ভৈরব দেব নন্দীকেশ্বর মহাদেব। মন্দিরের পিছনে রয়েছে কুণ্ড পুকুর। তন্ত্র মতে একটি শক্তিপীঠ যে স্থানে থাকবে সেই স্থানের কিছু বৈশিষ্ট্য থাকে। যেমন সেই স্থানটি পাশাপাশি জায়গা থেকে উঁচু হবে। উত্তরে নদী, পাশে থাকবে কুণ্ড এবং কাছেই থাকবে শ্মশান। এই সবকটি বৈশিষ্ট্য নন্দিকেশ্বরী পীঠে বিদ্যমান। অনেক বার এমন হয়েছে যে সাঁইথিয়া শহর বন্যায় ভেসে গেছে কিন্তু দেবীর মন্দির চত্বরে একফোঁটা জল ওঠেনি। অর্থাৎ মায়ের থানটি পাশাপাশি জায়গা থেকে উঁচুতে অবস্থিত। মন্দিরের উত্তরদিকে বইছে ময়ূরাক্ষী। এবং নিকটেই শ্মশান।
শোনা যায়, দেবী নিজেই স্বপ্ন দিয়ে তাঁর অবস্থানের কথা জানিয়েছিলেন দাতারাম ঘোষ নামে এক ভবঘুরে মানুষকে। দাতারাম আদতে দক্ষিণেশ্বরের অধিবাসী হয়েও ভাগ্য অন্বেষণে বীরভূমে চলে এসেছিলেন। দেবীর কৃপা লাভ করে তার ভাগ্য ফিরে গিয়েছিল। তিনি পরে দেওয়ান হওয়া থেকে শুরু করে জমিদারি কিনে জমিদার হয়েছিলেন। এই দাতারাম ঘোষ যখন প্রথম নন্দীপুরে এসেছিলেন তখন একদিন যাত্রাপথে ক্লান্ত হয়ে একটি বটগাছের তলায় শুয়ে নিদ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়েন। তিনি স্বপ্নে দেখেন এক দেবী তাকে বলছেন “আমি দেবী নন্দিকেশ্বরী মন্দির এই বটবৃক্ষ মূলে অবস্থান করছি। তুই আমার পুজোর ব্যবস্থা কর“। এরপর থেকেই দেবী নন্দিকেশ্বরী মন্দিরর পুজোর প্রচলন করেন তিনি। দেবীর আশিসে তিনি প্রচুর ধন সম্পদ লাভ করেন। ‘সাইত‘ করে মহাল কিনেছিলেন বলে ‘সাইতা‘- আর সেখান থেকেই এই শহরের নাম দাঁড়ায় সাঁইথিয়া।আশির দশকে সাঁইথিয়া শহরের ব্যবসায়ীরা সতীপীঠ নন্দিকেশ্বরীর অনেক সংস্কার করে বর্তমান মন্দির গড়ে তুলেছেন। অনেক দেবদেবীর মন্দির রয়েছে এখানে। মহাসরস্বতী, মহালক্ষ্মী, বিষ্ণুলক্ষ্মী, জলারামবাবার মন্দির, হনুমান মন্দির, জগন্নাথদেবের মন্দির, কালীয়দমন মন্দির তাদের মধ্যে অন্যতম। বিশাল বড় গাছটিতে ভক্তেরা তাদের ইচ্ছা পূরণের জন্য লাল এবং হলুদ সুতা বাঁধেন।
দেবী নন্দিকেশ্বরীর মূর্তি বলতে একটি পাথর। পাথরের গায়ে রয়েছে দেবীর তিনটি চোখ ও মাথায় মুকুট পড়ানো। মুকুটটি রূপালী এবং তিনটি চোখ সোনালী। যদিও মায়ের মূর্তিটি কালো পাথরের, কিন্তু বর্তমানে এর রঙ প্রায় লাল। কারণ ভক্তরা প্রার্থনার জন্য পাথরের গায়ে সিঁদুর দিয়ে থাকেন। চণ্ডীর পঞ্চম অধ্যায়ের মা দুর্গার ধ্যান মন্ত্রে এই পীঠে মা নন্দিনীকে পুজো করা হয়। কলা, বাতাসা দিয়ে দেবীকে ভক্তরা পুজো দিতে পারেন। দেবীকে প্রতিদিন অন্নভোগ নিবেদন করা হয় এবং তাতে একটি আমিষ পদ থাকে। একই সঙ্গে দেব নন্দীকেশ্বরেরও পুজো হয়। পৌষ মাসে মন্দিরে বার্ষিক বিরাট পুজো ও উৎসব অনুষ্ঠিত হয়।
• বক্রেশ্বর, বীরভূম – দেবী মহিষমর্দিনী , বীরভূমের পাপহরা নদীর তীরে অবস্থিত বক্রেশ্বর মন্দির। দেবীর দুই ভ্রুর মধ্যবর্তী অংশ এখানে পড়েছিল বলে কথিত রয়েছে। কেউ কেউ বলেন সতীর তৃতীয় নয়ন পড়েছিল। এখানে অধিষ্ঠিত দেবী মহিষাসুরমর্দিনী এবং ভৈরব বক্রেশ্বর বা বক্রনাথ। শক্তি উপাসনার জন্য পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলা অতি প্রাচীনকাল থেকেই উল্লেখ্য। এইখানেই সিদ্ধপীঠ তথা বক্রেশ্বর শক্তিপীঠ অবস্থিত । এখানে দেবীর মন মতান্তরে দুই ভ্রুর মধ্যবর্তী অঞ্চল পতিত হয়েছিলো । “পীঠমালামহাতন্ত্র” শাস্ত্রে লিখিত আছে –
বক্রেশ্বর মনঃ পাতু দেবী মহিষমর্দিনী
ভৈরব বক্রনাথস্তু নদী তত্র পাপহরা ।
উক্ত শাস্ত্র মতে দেবী সতীর মন এইস্থানে পড়েছিলো বলে বলা হয় । দেবীর নাম মহিষমর্দিনী , ভৈরব হলেন বক্রেশ্বর । পাপহরা বক্রেশ্বর নদীর পাশে এই পীঠ অবস্থিত । “শিবচরিত” মতে এইস্থানে দেবীর দক্ষিণ বাহু পতিত হয়েছিলো। দেবীর নাম বক্রেশ্বরী ভৈরব হলেন বক্রেশ্বর । তবে এখানে দশভুজা মহিষাসুরনাশিনী চণ্ডী রূপে দেবীর পূজা হয় । মহিষাসুরকে বধ করে দেবীর একনাম হয়েছিলো মহিষমর্দিনী । এই পীঠ শিবভক্তির জন্য বিখ্যাত । মহামুনি অষ্টবক্র মুনি এইস্থানে শিব উপাসনা করেছিলেন । “ব্রহ্মাণ্ড পুরাণে” এর ঘটনা আছে ।
“ক্রোধ” হোলো মহা শত্রু । ক্রোধের জন্য অনেক সর্বনাশের পথ উন্মোচন হয় । পুরাণ গুলিতে সেই তত্ত্ব কথাই নানান গল্পে প্রকাশিত হয়েছে বারবার । সেটা সমুদ্র মন্থনের পরবর্তী ঘটনা । মা লক্ষ্মীর সাথে ভগবান বিষ্ণুর বিবাহের আয়োজন চলছে । সমস্ত মুনি ঋষি গণ আমন্ত্রিত । এমন সময় ঋষি লোমশ ও ঋষি সুব্রত সেই বিবাহে যোগদান করতে এসেছেন । দেবরাজ ইন্দ্র দুই ঋষিকে সাদর অভ্যর্থনা জানিয়ে প্রথমে লোমশ মুনিকে পাদ্যঅর্ঘ্য দিলেন । এতে মুনি সুব্রত ক্রুদ্ধ হলেন, কেন কি তিনি ভেবেছিলেন মহেন্দ্র প্রথমে তাঁকে আপ্যায়ন করবেন । মুনি ইন্দ্রদেবতাকে অভিশাপ দিতে উদ্যত হলেন । শাপ দিতে গিয়ে তাঁর বিবেকবোধ জাগ্রত হোলো, তিনি বুঝলেন ঋষির কর্তব্য হোলো ক্রোধের ওপর বিজয় প্রাপ্তি করা। মুনি সুব্রত ক্রোধকে নিয়ন্ত্রন করতে গেলে তাঁর শরীর আট অংশে বক্র হোলো– সেই থেকে তিনি অষ্ট বক্র নামে পরিচিত হলেন । এরপর মহামুনি তীর্থ ভ্রমণে বের হলেন । বর্ধমানে এসে কালী উপাসনা শুরু করলেও দেবী তাঁকে ক্ষমা করলেন না । অষ্টবক্র মুনি এরপর বক্রেশ্বরে এসে ভগবান শিবের উপাসনা শুরু করলেন । ভগবান শিব প্রসন্ন হয়ে দর্শন দিয়ে তাঁকে স্বাভাবিক সুস্থ করলেন । মহেশ্বর বরপ্রদান করে বললেন– “তোমার নামের সাথে বক্রেশ্বর শিব নামে আমি পূজিত হবো এখানে। আমার অগ্রে এখানে তোমার পূজা হবে।” এই থেকে এখানে মহামুনি অষ্টবক্রের নামে একটি শিবলিঙ্গ স্থাপন হোলো। ভৈরবের আগে এখানে মহামুনির পূজা হয় ।
মহাভারতে আবার ভিন্ন কাহানী আছে । সেখানে আছে মুনি অষ্টবক্র তাঁর পিতার অভিশাপে প্রতিবন্ধী হয়েছিলেন । পিতা তো সন্তান কে স্নেহ করেন। কেন এক পিতা তাঁর সন্তান কে অভিশাপ দিলেন ? মহাভারতে এই ঘটনার অন্য একটি বিবরণ আছে । মহাভারতে কহোড় নামক এক ঋষির কথা শোনা যায় । তিনি যখন শিষ্যদের বেদ শিক্ষা দিতেন তখন তাঁর স্ত্রী সুজাতা সেই বেদ পাঠ শুনতেন । সুজাতার গর্ভে তখন ঋষির সন্তান , তখন নিয়ম করে সুজাতা দেবী বেদ পাঠ শুনতেন । হিন্দু ধর্মে নিয়ম আছে গর্ভবতী নারীদের ধর্ম গ্রন্থ, ঈশ্বরের আলোচনা শ্রবন করা উচিৎ। এতে গর্ভের শিশু ধার্মিক ও দীর্ঘায়ু হয়। উল্টো দিকে গর্ভবতী নারীদের ভূত প্রেতের গল্প শ্রবন , ঝগড়া, পর নিন্দা পরচর্চা থেকে বিরত থাকার বিধান । ঋষির মুখ থেকে বেদ পাঠ তাঁর গর্ভস্থ সন্তান শুনতেন । যাই হোক মেধাবী সেই সন্তান জন্ম নিলো। একদিন শিষ্যদের সামনে বালক তাঁর পিতা কহোড় মুনিকে বললেন– “পিতা আপনার বেদান্ত শিক্ষা দান পদ্ধতি ভুল আছে। আপনার উচ্চারনে জড়তা আছে। আপনি অনেক মন্ত্র সঠিক ভাবে উচ্চারন করতে পারেন না।” এতে কহোড় মুনি রেগে পুত্রকে দেহের আট স্থান বক্র হবার শাপ দিলেন । সেই থেকে মুনির নাম হোলো অষ্টবক্র । কহোড় এর পত্নী সুজাতা এতে রেগে পুত্রকে নিয়ে পিতা উদ্দালক মুনির আশ্রমে চলে গেলেন ।
উদ্দালক মুনি অষ্টবক্রের ভাগ্য গণনা করে জানালেন– “চিন্তা কোরো না মা সুজাতা। একদিন অষ্টবক্র তাঁর পিতাকে উদ্ধার করবে।” অপরদিকে সুজাতা একদিন শুনলেন তাঁর স্বামীকে মানে অষ্টবক্রের পিতাকে রাজা জনকের সেনারা ধরে নিয়ে গেছে । সুজাতার একটি অল্প বয়স্ক ভ্রাতা ছিলো তাঁর নাম শ্বেতকেতু । বালক অষ্টবক্র একদা তাঁর দাদু উদ্দালক মুনির কোলে বসে ছিলো– এই দেখে তাঁর মামা শ্বেতকেতু রেগে গেলো। বলল – “যাও গিয়ে নিজের পিতার ক্রোড়ে বসো। কেন আমার পিতার ক্রোড়ে বসে আছো?” শুনে বালক অষ্টবক্র এসে সুজাতাকে প্রশ্ন করলো– “মা আমার পিতা কোথায়?” সুজাতা জানালো তোমার পিতা মহর্ষি কহোড় কে জনকরাজার সেনারা ধরে নিয়ে গেছে । শুনে বালক ঠিক করলো তার পিতাকে খুঁজে আনবে । এই ভেবে মামা শ্বেতকেতুর সাথে বালক অষ্টবক্র জনক রাজার দরবারে গেলো। সেখানে শাস্ত্র আলোচনা হচ্ছিল্ল। রাজা জনক দুই বালককে আদর যত্ন আপ্যায়ন করলেন । বালক অষ্টবক্র জনক রাজার সভা পণ্ডিতের সাথে তর্ক যুদ্ধ করতে চাইলো। তর্ক যুদ্ধে জনকের সভাপণ্ডিত অষ্টবক্রের কাছে পরাজিত হোলো । রাজা জনক পুরস্কার দিতে চাইলে বালক জানালেন– “মহারাজ । আপনার সেনারা আমার পিতাকে ধরে নিয়ে গেছে। আমার পিতাকে ফিরিয়ে দিন। ইহাই আমার কাম্য ।”
রাজার সেনারা জানালো সভাপণ্ডিতের আদেশে তারা মুনি কাহোর কে ধরে সমুদ্রে ফেলে দিয়েছেন । শুনে রাজা সভাপণ্ডিত কে খুব বকাঝকা করে তাকে সমুদ্রে ফেলবার আদেশ দিলো । সভাপণ্ডিত জানালো– “রাজা জনক। আমি বরুণ দেবের পুত্র । আমার পিতা বরুণ দেব সমুদ্র তলে এক যজ্ঞের আয়োজন করেছেন । সেই জন্য কিছু পুরোহিতের প্রয়োজন। তাই আমি মহর্ষি কাহোর কে সমুদ্রে নিক্ষেপ করেছি।” সকলে সমুদ্র তটে গিয়ে বরুণ দেবতার কাছে প্রার্থনা জানালো। সাথে সেই সভাপণ্ডিত কে সমুদ্রে ফেলা হোলো। সাথে সাথে অনেক বন্দী ব্রাহ্মণ সমুদ্র থেকে উঠে এলো । তাদের মধ্যে ঋষি কাহোড় ছিলো । পিতা তাঁর পুত্রকে চিনতে পেরে ক্রোড়ে নিয়ে আদর স্নেহ করলেন । সুজাতা তাঁর স্বামীকে ফিরে পেলো। একবার এক সুন্দর গন্ধর্ব অষ্টবক্র মুনিকে দেখে হাসি মজাক করলে মুনি অষ্টবক্র তাকে অভিশাপ দিয়ে কদাকার বিশাল সাপে পরিণত করেন । সেই গন্ধর্ব ক্ষমা চাইলে মুনি বলেন– “দ্বাপরে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তোমায় বধ করে তোমাকে শাপমুক্ত করবেন।” এই হোলো অষ্টবক্র মুনির কথা। যাঁর সাথে এই পীঠের নাম জড়িত
বীরভূমের বক্রেশ্বরে এই শক্তিপীঠে ৮টি কুণ্ড দেখা যায় । এই কুণ্ডগুলির মাহাত্ম্য এক একটি এক রকম । ১) “ক্ষারকুণ্ড”– এর একটি ঘটনা আছে । একবার মহর্ষি অগস্ত্য সাগর বারি এক গণ্ডূষে পান করতে আরম্ভ করেছিলেন । সেসময় লবণ সাগর এখানে একটি কুণ্ড আকারে আশ্রয় নেয় । আষাঢ় মাসের পূর্ণিমা তে এই কুণ্ডে অবগাহন করলে অক্ষয় কাল স্বর্গে তার স্থান হয় । ২) “অগ্নিকুণ্ড”– হিরন্যকশিপু কে বধ করতে ভগবান বিষ্ণু নৃসিংহ অবতার নিয়েছিলেন। অসুর বধের পর ভগবান নৃসিংহের ক্রোধে সমগ্র ব্রহ্মাণ্ড ধ্বংস হবার উপক্রম হলে ভক্ত প্রহ্লাদ , ভগবানের চরণে পড়ে স্তবস্তুতি করলে ভগবান হরি তুষ্ট হন। ভগবান বিষ্ণুর সবথেকে উগ্র অবতার হলেন নৃসিংহ অবতার । ভগবান নৃসিংহ তাঁর তেজ থেকে এক কুণ্ড নির্মাণ করেন এখানে, এর নাম অগ্নিকুণ্ড । এখানে কেউ স্নান করেন না। কারন এই কুণ্ডের তাপ অনেক। তবে বৈশাখী পূর্ণিমা তে এখানে পিণ্ড দিলে পিতৃপুরুষেরা মুক্তি লাভ করেন । ৩) “ভৈরবকুণ্ড” – ভগবান শিব সর্ব পবিত্র নদী, পুষ্করিণীর জল একত্র করে এখানে একটি কুণ্ড নির্মাণ করেন। যাঁর নাম ভৈরবকুণ্ড। এখানে চৈত্র মাসের শুক্ল অষ্টমীতে স্নান করলে রাজসূয় যজ্ঞের ফল লাভ হয় ।
৪) “সৌভাগ্যকুণ্ড”– দেবাদিদেব ভগবান শিব ও তাঁর সহধর্মিণী মাতা ভবানীর সমস্ত অঙ্গের স্বেদ বিন্দু থেকে এই কুণ্ডের উৎপত্তি হয় । এখানে স্নান করলে সর্ব পাপ নষ্ট হয়ে, ভক্তেরা দেহান্তে কৈলাস লোক প্রাপ্তি করেন । ৫) “জীবিতকুণ্ড”—নিশানাথ সোমদেব এখানে স্নান করে সুস্থ হন। অনেক আগে সর্বনাম নামক এক ব্রাহ্মণ তাঁর পত্নী চারুমতির সাথে এখানে তীর্থ করতে আসেন। ব্রাহ্মণ এখানে বাঘের পেটে গেলে, ব্রাহ্মণী ভগবান শিবের আরাধনা করেন । ভগবান শিব প্রকট হয়ে ব্রাহ্মণীকে আদেশ দেন , ব্রাহ্মণের অস্থি এই কুণ্ডে নিক্ষেপ করতে। ব্রাহ্মণী তা করতেই কোথা থেকে যেনো ব্রাহ্মণ বেঁচে ফিরে এলেন। মাঘ মাসের শুক্ল অষ্টমীতে এই কুণ্ডে স্নান করলে অপমৃত্যু হয় না । ৬) “ব্রহ্মাকুণ্ড”– প্রজাপতি ব্রহ্মা এখানে পাপ স্ফলনের জন্য এখানে কুণ্ড খনন করে ‘ত্যম্বক’ মন্ত্রে আহুতি দিয়ে যজ্ঞ করেন। এই কুণ্ডে স্নান করলে ব্যভিচারাদি পাপ দূর হয় ।
৭) “শ্বেতগঙ্গা”– এই স্থানে সত্য যুগে শ্বেত নামক এক রাজা থাকতেন । তিনি রোজ এখানে ভৈরব বক্রনাথের পূজা দিতে আসতেন । বক্রনাথ তুষ্ট হয়ে বর দিলেন যে এই তীর্থের সাথে রাজা শ্বেতের নাম জড়িয়ে থাকবে । এই বলে ভৈরব বক্রনাথ এখানে এক কুণ্ড সৃষ্টি করলেন । ঐ কুণ্ডের নাম শ্বেতগঙ্গা । মাঘ মাসে এই কুণ্ডে স্নান করলে গঙ্গা স্নানের পুন্য প্রাপ্তি হয় । ৮) “বৈতরণী”– বৈতরণী পার হলে যম লোক থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। তাই এই কুণ্ডে অবগাহনে নরক ভয় দূর হয় । এই হোলো এই অষ্ট কুণ্ডের কথা । এই তীর্থ অনেক প্রাচীন । চৈতন্য ভাগবতেও এই তীর্থের কথা আছে। একস্থানে মহাপ্রভু বলেছেন-
বক্রেশ্বর আছেন যে বনে
তথায় যাইনু মুঁঞি থাকিমু নির্জনে ।
বক্রেশ্বর তীর্থ এক সময় গভীর জঙ্গলে ঢাকা ছিলো। সেই অরন্যে সাধারন মানুষ থাকতো না। থাকতো কেবল বীরাচারী তন্ত্র সাধক, অঘোরী সাধু, কাপালিক । দেবীর কৃপা প্রাপ্তির জন্য তাঁরা কঠিন সব সাধনায় নিমগ্ন থাকতো । মা মহিষমর্দিনী কৃপা করতেন এই ভক্তদের । মায়ের কৃপা প্রাপ্তির জন্য তাই আজ কত ভক্ত এখানে আসেন। মহামায়া ভক্তদের কৃপা করবার জন্যই সতী রূপে অবতীর্ণা হয়ে স্বীয় অঙ্গ দ্বারা দেবীপীঠ সৃষ্টি করলেন । মহাশক্তি রূপে তিনি সেখানে বিরাজিতা থেকে অশেষ কল্যাণ সাধন করছেন । এই পীঠকে কাশীর সাথে তুলনা করা যেতে পারে । কাশীতে যেমন গঙ্গা কলি কলুষ নাশ করে চলেছেন , এখানেও তেমনি শ্বেতগঙ্গা পাপ দূরীকরণ করেন । আর আছেন মা মহিষমর্দিনী ও ভৈরব বক্রনাথ । এই স্থানের পাশেই বক্রেশ্বর নদীর পাশেই মহাশ্মশান আছে । শ্মশানের ভেতরে সিদ্ধতান্ত্রিক অঘোরীবাবার সমাধি আছে । এখনও নাকি রাতের দিকে সেই অঘোরীবাবার পবিত্র বিদেহী আত্মাকে ভাগ্যবানেরা দর্শন করে থাকেন ।
এখানে এখনও তন্ত্র সাধকদের দেখা যায় । ভৈরব বক্রনাথের মন্দিরের ডানদিকে দেবীর মন্দির দেখা যায় । দেবীর এখানে পিতলের মূর্তি দেখা যায় । এই মূর্তি দশভুজা ও মহিষাসুর কে বধ করছেন এমন রূপ– যেমন আমরা দুর্গা মূর্তি দেখি । তবে এ ই পীঠে অনেক আগে কষ্টি পাথরের মূর্তিতে পূজা হোতো । কালাপাহাড়ের আক্রমণের সময় পূজারীরা সেই মূর্তি একটি পুকুরে ডুবিয়ে পালিয়ে যায় । পরবর্তী কালে পুকুর সংস্কার করবার সময় সেই পুরানো মূর্তি পাওয়া যায় । পুরানো মূর্তি এখন ডিহি বক্রেশ্বর গ্রামে নিয়ে রাখা আছে। সেখানেই পূজা হয় । প্রাচীন এই কষ্টি পাথরের মূর্তিতে অষ্টাভুজা মহিষমর্দিনী চণ্ডী মূর্তি আছে । তাঁর সাথে নয়টি শক্তি দেবীও আছেন। যথা– কৌমারী, ইন্দ্রাণী, বৈষ্ণবী, বারাহী, তারা, ষোড়শী, ভুবনেশ্বরী, ভৈরবী ও দেবী চন্দ্রঘণ্টা । বোলপুর থেকে সিউরি হয়ে মাত্র ১৯ কিমি গেলে বক্রেশ্বর । এই হোলো বক্রেশ্বর শক্তিপীঠের বর্ণনা। মা মহিষমর্দিনী কে প্রনাম মন্ত্র-
অয়ি সুমনঃ সুমনঃ সুমনঃ সুমনোহর কান্তিযুতে
শ্রিতরজনী রজনী রজনী রজনী রজনীকর বকত্রবৃতে ।
সুনয়ন বিভ্রমর ভ্রমর ভ্রমর ভ্রমর ভ্রমরাধিপতে
জয় জয় হে মহিষাসুরমর্দিনী রম্যকপর্দিনি শৈলসুতে ।।
অনুবাদ– হে মাতঃ! সহৃদয় দিব্যধামবাসিগণের উদ্যানে প্রস্ফুটিত পারিজাত পুস্পের লোভনীয় উজ্জ্বলতার অধিকারিণী তোমার মুখমণ্ডল চন্দ্রের জ্যোৎস্নায় আলোকিত হয়ে ( তারই মতো ) সুন্দর, তোমার নয়নযুগল ভ্রমরাক্ষিসদৃশ , তোমার কণ্ঠে শোভামান যে পুস্পমাল্য তা ভ্রমরে ভ্রমরে আচ্ছাদিত থাকায়, তুমি নিজেই ‘ভ্রমর’ নামধেয়া অথবা ‘ভ্রমরদের’ ঈশ্বরীরূপে পরিগণিতা । । তুমি শৈলসুতা জটাজুটধারিণী পার্বতী । তুমিই মহিষাসুর বধ করেছো । তোমায় জয় হোক ।
• ফুল্লরা , বীরভূম – দেবী ফুল্লরা , এটি অবস্থিত বীরভূম জেলার লাভপুরের কাছে। অনেকে এটিকে উপপীঠও বলেন। পুরাণ অনুযায়ী, এখানে দেবীর ওষ্ঠ পড়েছিল। দেবী এখানে ফুল্লরা এবং ভৈরব বিশ্বেশ। আমাদের বাংলায় বীরভূম এমন একটি জেলা যে জেলায় রয়েছে ৫১ সতীপীঠের মধ্যে পাঁচটি সতী পীঠ। কামাখ্যার পরই তন্ত্রসাধনার কেন্দ্রস্থল এই বীরভূম জেলা। বীরাচারী তান্ত্রিকদের সাধনার স্থল বীরভূম। আমরা জানি তন্ত্রসাধনার এক নতুন দিকনির্দেশক তান্ত্রিক কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশের জীবন্ত সমাধি আছে মল্লারপুরে, মল্লেশ্বর শিব মন্দির এর ভেতরে।
বাংলার আর কোন জেলাতেই এত পীঠের সমাহার দেখা যায় না। এছাড়াও রয়েছে একটি সিদ্ধ পীঠ। তারাপীঠ। যা প্রাচীনকালে ছিলো বশিষ্ঠ মুনির সাধনার স্থল। পরবর্তীকালে সাধক বামদেব এখানে সাধনায় সিদ্ধি লাভ করেছিলেন। যিনি বামাক্ষ্যাপা নামে আমাদের সবার কাছে পরিচিত। এই লাভপুরে ফুল্লরা সতীপীঠ ছিল বশিষ্ঠের পরবর্তী বংশধর অট্টহাসের সাধনক্ষেত্র। যার জন্য ফুল্লরা সতীপীঠের আরেক নাম অট্টহাস। কেউ কেউ “ফুল্লরা অট্টহাস“ও বলে থাকেন।
বীরভূমের লাভপুরে অবস্থিত এই সতীপীঠ ফুল্লরা। পীঠ নির্ণয় তন্ত্র অনুসারে এখানে সতীর নিচের ওষ্ঠ বা ঠোঁট পড়েছিল। দেবীকে এখানে ফুল্লরা নামে পুজো করা হয়। আর দেবী ভৈরব হলেন বিশ্বেশো।
পীঠনির্ণয় তন্ত্রে বলা হয়েছে,
“অট্টহাসেচোষ্ঠপাতো দেবী সা ফুল্লরা স্মৃতা।
বিশ্বেশো ভৈরবস্তত্র সর্ব্বাভীষ্ট প্রদায়কঃ।।“
তবে স্থানীয় মানুষদের কাছে এখানকার দেবী অধরেশ্বরী দেবী নামেও পরিচিতা ও পূজিতা।
পীঠ নীর্ণয়তন্ত্রে ও কুজ্জিকাতন্ত্রে এই স্থানটিকে মহাপীঠ বলে উল্লেখ করা হয়েছে ।
তন্ত্র চূড়ামণি মতে এবং শিবচরিতে ফুল্লরাকে উপপীঠ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। আবার শিব সংহিতায় ফুল্লরাকে মহাপীঠ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। দেবী এখানে ভক্তের সর্ব অভীষ্ট প্রদায়িনী।
তবে এখানে সতীর ঠোঁট পড়া নিয়ে মতভেদ আছে। নগেন্দ্রনাথ বসুর মতে পূর্ব বর্ধমানের কেতুগ্রামের কাছে অট্টহাসে দেবীর ঠোঁট পড়েছিল। সুতরাং ওই অট্টহাসই হলো সতীপীঠ। তবে সতীপীঠের স্থান নির্ণয় বিষয়ক বিশিষ্ট গবেষক ডি. সি সরকারের মতে বীরভূম জেলার লাভপুরের এই অঞ্চলটি হলো অট্টহাস সতীপীঠ।
অতীতে এই লাভপুরের নাম ছিল সামলাবাদ। কথিত আছে সামলাবাদের শেষ রাজা মৈথিলী ব্রাহ্মণ দিনমনি সিংহই এই ফুল্লরা পীঠে পুজো শুরু করেন। তার বহু পরে গয়ার শঙ্করাচার্য মঠ থেকে কৃষ্ণানন্দ গিরি নামে এক সন্ন্যাসী স্বপ্নাদেশ পেয়ে এখানে এসে মাঘী পূর্ণিমার দিন মাতৃ আরাধনায় যোগ দেন।
সেই জন্য প্রতিবছর মাঘী পূর্ণিমায় মায়ের বিশেষ পুজো হয় এবং সেই উপলক্ষে ১০–১২ দিনব্যাপী মেলাও বসে। সেদিন বহু দূর–দূরান্ত থেকে ভক্তরা এসে এখানে মায়ের পুজো দেন। মেলা থেকে নানা রকম জিনিসপত্র কেনাকাটা করেন। বাউল গানের আসর বসে। সেখানে গান শোনার জন্য মানুষের ভিড় জমে যায়। খাবারের দোকানও বসে নানা রকমের। সেইসব দোকানের খাবার খেয়ে তারা বাড়ির দিকে রওয়ানা দেন।
বর্তমান মন্দিরে প্রাচীনত্বের কোন চিহ্নই আর অবশিষ্ট নেই। শোনা যায় বহিশত্রুর আক্রমণে মূর্তি ও মন্দির ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। বর্তমান মন্দিরটি দালান রীতির, ত্রিখিলান বিশিষ্ট।
মন্দিরের সামনের দিকটা টেরাকোটার ফলক দিয়ে অলংকৃত। তাতে নানা দেবদেবী ও কৃষ্ণলীলার নানান প্রতিকৃতি রয়েছে। মন্দিরের ত্রিকোণাকৃতি চূড়ার দুদিকে দুটি সিংহ এবং মাঝখানে ধ্যানরত মহাদেবের মূর্তি রয়েছে।
মন্দিরের সামনেই রয়েছে হাঁড়িকাঠ।
মন্দিরের গর্ভগৃহে রয়েছে একটা বড় আকারের পাথরের উপরিভাগ। যা দেখতে অনেকটা কচ্ছপের পিঠের মতন। তার সামনের দিকটা অনেকটা ঠোঁটের মতন। আর ওই পাথরের উপরিভাগের পুরোটা লাল সিঁদুর দিয়ে রাঙানো। গাঁদা ফুল, জবা ফুল ও বেলপাতা দিয়ে পাথরের সামনের দিকটা সাজানো । পাথরটির মাথার উপরে রয়েছে রুপোর ছাতা। ওই পাথরটিকেই দেবী ফুল্লরা হিসেবে পূজা করা হয়। এছাড়াও একটি ছোট নকশাদার প্রস্তরখন্ডকেও এখানে পূজো করা হয়। এখানে দেবীকে জয় দুর্গা ধ্যানে পুজো করা হয়। এখানে মায়ের কোন মূর্তি নেই। মন্দিরের সামনে নাট মন্দির। আর নাট মন্দিরের পরেই রয়েছে একটি পুকুর। যার ঘাটটি বাঁধানো। এই দীঘির নাম দেবীদহ বা দলদলি।
শোনা যায় এই দিঘির জল নাকি কোনদিন শুকায় না। এই দিঘিতে নাকি প্রচুর পদ্মফুল ফোটে। কিংবদন্তী আছে, শ্রীরামচন্দ্র যখন দূর্গা পুজো করেছিলেন, তখন হনুমান এই দীঘি থেকে থেকে ১০৮ টি পদ্ম নিয়ে গিয়েছিলেন। প্রতিবছর দুর্গাপুজোর সময় পুকুরের উত্তর পূর্ব দিক থেকে ভেসে আসে একটা অদ্ভুত আওয়াজ। তারপরই হয় মায়ের সন্ধি পুজো। এই মন্দিরে সন্ধিপূজা শুরু হলেই আশেপাশের সমস্ত মন্দিরে সন্ধিপূজা শুরু হয়।
মাকে প্রতিদিন অন্নভোগ দেয়া হয়। আর অন্য ভোগের সাথে মাছের টক থাকবেই। মন্দিরে শিবা ভোগ দেওয়ার প্রথা রয়েছে।
মন্দির চত্বরে প্রবেশপথে রয়েছে একটি তোরণদ্বার। যার ভিতর দিয়ে প্রবেশ করলেই চোখে পড়বে গাছপালা দিয়ে ঘেরা ছায়াসুনীবিড় মন্দির প্রাঙ্গণ। ৬৬ বিঘা জমি নিয়ে এই মন্দির চত্বর। একটা সময় এই মন্দিরের কাছাকাছি কোন জনবসতি ছিল না। মন্দিরের কাছেই রয়েছে উত্তর বাহিনী কোপাই নদী। আর আছে মহাশ্মশান। একটা সময় এই অঞ্চল ছিলো জঙ্গলাকীর্ন। বন্য জন্তুদের বিচরণ ভূমি। এখনো নাকি এখানে রাত হলে প্যাঁচার ডাক আর শিয়ালের হুক্কা হুয়া শোনা যায় তোরণ দিয়ে প্রবেশ করে কয়েকটা পা এগিয়ে গেলেই বাঁদিকে পড়বে মন্দির। আর মন্দিরের পাশেই রয়েছে ভৈরব বিশ্বেশো বা বিশ্বেশ্বরের মন্দির।
• ক্ষীরগ্রাম, পূর্ব বর্ধমান – দেবী যোগাদ্যা , এই পীঠও বর্ধমানে অবস্থিত, বর্ধমানের ক্ষীরগ্রামে। এখানে সতীর ডান পায়ের আঙুল পড়েছিল বলে কথিত রয়েছে। দেবীর নাম এখানে যোগাদ্যা বা যুগাদ্যা এবং ভৈরব হলেন ক্ষীরকণ্ঠক। একান্নপীঠের অন্যতম পীঠস্থান ক্ষীরগ্রাম। ভারতচন্দ্রের ‘অন্নদামঙ্গলে’ লিপিবদ্ধ আছে–
‘ক্ষীরগ্রামে ডানিপার অঙ্গুষ্ঠ বৈভব।
যুগদ্যা দেবতা ক্ষীরখণ্ডক ভৈরব॥’
এখানে সতীর ডান পায়ের বুড়ো আঙুল পড়েছিল, দেবী এখানে যোগাদ্যা, ভৈরব ক্ষীরখণ্ডক। কাটোয়া মহকুমায় অবস্থিত এই সতীপীঠ অন্যান্য তিনটি পীঠ থেকে স্বতন্ত্র জনপ্রিয় এবং প্রাচীন। কোন পৌরাণিককালে ক্ষীরগ্রামে যোগাদ্যা মায়ের আবির্ভাব ঘটেছিল তা বলা কঠিন। কৃত্তিবাসের রচনায় পাই–
যোগাদ্যাং যোগমাতাষ্ণ
যোগী যোগ প্রদায়িনীম।
অনন্ত মায়া শক্তিষ্ণ
দেবীমন্ত রূপিম॥’
মা যোগাদ্যা দেবী মহামায়ার এক রূপ। মার্কণ্ডেয় পুরাণ থেকে দেবীর বর্ণনা পাওয়া যায়। মহাকালী বা ভদ্রকালীর সেবক মহীরাবণ রাম–লক্ষ্মণকে হতা করার জন্যে পাতালে নিয়ে যান, দেবীর কাছে বলিদানের পূর্বে রাম ভক্ত হনুমান মহীরাবণকে বধ করে রামলক্ষ্মণকে উদ্ধার করে দেবী মূর্তিসহ ক্ষীরগ্রামে উপস্থিত হন। রাম–লক্ষ্মণ এখান থেকে চলে গেলেও ‘মহাকালী’ এখানকার ভূমিজসন্তানদের দ্বারা পূজিত হতে শুরু করেন।
বর্ধমান রাজ কীর্তিচাঁদ রায় ১৭২২ খ্রিস্টাব্দে দেবীর এই মন্দিরটি নির্মাণ করেন। গঠনশৈলী ও স্থাপত্য রীতিতে অভিনবত্ব লক্ষ্য করা যায়। মূল প্রবেশপথ জোড়াবাংলা ও পশ্চিম ভাগ দোচালা বাংলারীতিতে নির্মিত। গর্ভগৃহে একরত্নমন্দির সামনে আটটি থামের উপর বিশাল নাটমন্দিরটি তিনটি স্তরে বিন্যস্ত। মন্দিরের পাশেই ভৈরব ক্ষীরখণ্ডকের মন্দির। দেবী মূর্তির রূপকার হলেন নবীন ভাস্কর। শোনা যায়, সিংহপৃষ্ঠে আসীন কালো কষ্টিপাথরের দশভুজা মহিষমর্দিনী শক্তির দেবী যোগাদ্যার আসল মূর্তিটি হারিয়ে গেছিল অনেক আগেই। এরপরে, বর্ধমানের রাজা কীর্তি চন্দ্র রায় অষ্টাদশ শতকের তৃতীয় দশকে প্রায় ৮ বিঘা জমির উপর গ্রামের মূলভাগ থেকে ৫ ফুট উচ্চতায় যোগাদ্যার মন্দির নির্মাণ করান। যার তোরণদ্বারের স্থাপত্য নজরকাড়া। সম্ভবত তাঁরই নির্দেশে হারিয়ে যাওয়া মূর্তিটির অনুকরণে একটি দশভুজা মহিষমর্দিনী মূর্তি তৈরি করেন দাঁইহাটের প্রস্তর শিল্পী নবীনচন্দ্র ভাস্কর। নতুন মূর্তিটি বছরের অন্যান্য সময়ে ডুবিয়ে রাখা হত ক্ষীরদিঘির জলেই। কেবল ৩১ বৈশাখ তা জল থেকে তুলে আনা হত সর্বসমক্ষে।
একই দেবীর জোড়া মূর্তি নিয়ে জোড়া মন্দির নিয়ে প্রচলিত রয়েছে একটি অলৌকিক ঘটনা। শোনা যায়, ক্ষীরদিঘি সংস্কারকালে নতুন মূর্তির সঙ্গে উঠে আসে হারিয়ে যাওয়া পুরোনো যোগাদ্যা মূর্তি। মূর্তি ফিরে পাওয়ার আনন্দে গ্রামিবাসীরা গড়ে তুললেন সম্পূর্ণ আলাদা একটি মন্দির। সেই মূর্তি প্রতিষ্ঠিত হয় নতুন মন্দিরে। সংক্রান্তিতে দুই মন্দিরেই চলে দেবীর আরাধনা।
বিশাল ক্ষীরদীঘির জলের মধ্যে একটি অপরূপ শ্বেত পাথরের মন্দির ২০০৪ সালে নির্মাণ করা হয়। মূর্তিটি মন্দিরের ভিতরে শায়িত রাখা হয়। বৈশাখ সংক্রান্তিতে দেবী মূর্তি জল থেকে তোলা হয়, ঐ দিন বিশাল ভক্ত সমাগম ঘটে, মেলা বসে। এছাড়াও ৪ঠা জ্যৈষ্ঠ সন্ধ্যার সময় দেবীকে জল থেকে তোলা হয়, পুজোর পর রাতে পুনরায় মন্দিরে মাকে শুইয়ে রাখা হয়। অক্ষয় নবমী, বিজয়া দশমী ইত্যাদি সময়ে দেবীকে জল থেকে তুলে বিশেষ পুজো করা হয়। ২০০৯ সালে ক্ষীরদীঘির সংস্কার করার সময় মহিষমর্দ্দিনী দশভুজা যোগাদ্যাদেবীের একটি মূর্তি পাওয়া যায়। ২০১১ সালে একটি লাল পাথরের মন্দিরের নির্মাণ করে মূর্তিটি প্রতিষ্ঠা করা হয়। সেখানে নিত্যপুজো হয়। ভক্তরাও দেবীকে দর্শন করতে পারেন। পশু বলিদান প্রথা চালু আছে।যোগাদ্যা আদতে কৃষিদেবী। চৈত্র সংক্রান্তির দিন যোগ্যাদ্যার যে উৎসব হয়, তা এক মাস ধরে নানান রীতি, আচারের মধ্যে দিয়ে চলে । উল্লেখ্য হল লগ্ন উৎসব, জলমগ্ন, ক্ষীর কলস সিঞ্চন, ময়ূর নাচ, মৌর নাচ, বীরদর্পে মাটি কাঁপানো উৎসব, মালাকারের বিয়ে, উলগ পুজো, ডোম–চুয়ারি খেলা শেষে মহাপুজো। কিংবদন্তী নরবলি প্রথা ছিল, এখনও ডোম সম্প্রদায়ের এক মাতৃভক্ত মাকে রক্ত নিবেদন করেন। দেবী যোগাদ্যাকে নিয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে অসংখ্য লৌকিক ইতিহাস। শোনা যায়, মাঝরাতে দেবীর গর্ভগৃহের বন্ধ দরজার সামনে ঢাক বাজানো হয়। ঢাকের সেই বোল শুনে দেবী যোগাদ্যা ‘নৃত্য’ করেন। তবে সে সময় দেবীর ওই নাচের দৃশ্য কেউ দেখতে পান না। শুধুমাত্র ঢাকিই পায়ের নূপুরের শব্দ শুনে তা বুঝতে পারেন।পূর্ব বর্ধমান জেলার মঙ্গলকোটের ক্ষীরগ্রামের দেবী যোগাদ্যার মন্দিরের গর্ভগৃহের সামনে একমাস ধরে পালন করা হয় এই বিশেষ আচার। যে আচার ‘নিশি ঢম্বুল’ বলে পরিচিত। পৌষের সংক্রান্তির দিন থেকে মাঘ মাসের সংক্রান্তির পর্যন্ত পালন করা হয় ‘নিশি ঢম্বুল’। তবে নিয়ম রয়েছে এই ‘নিশি ঢম্বুল’ পালনে শুধুমাত্র এক ঢাকিই শুধু থাকতে পারবেন। দেবীর মন্দিরের কাছে তখন আর কেউ ঘেঁষতে পারবেন না।
এখানে ভোগ খাওয়ানোর ব্যবস্থা রয়েছে, রয়েছে অতিথিশালা। গ্রামীণ আবহে এক পুত প্রশান্তি এই সতীপীঠ।
• কেতুগ্রাম, পূর্ব বর্ধমান– দেবী বাহুলা এবং বাহুলাক্ষী , এই সতীপীঠ অবস্থিত বর্ধমান জেলার কেতুগ্রামে অজয় নদের ধারে। পৌরাণিক কাহিনী বলে, এখানে দেবীর বাঁ হাত পড়েছিল। এখানে অধিষ্ঠিত দেবীর নাম বহুলা এবং ভৈরব পরিচিত ভীরুক নামে। বর্ধমানের কাটোয়া থেকে প্রায় সতেরো কিলোমিটার দূরে কেতুগ্রামে বহুলা সতীপীঠ অবস্থিত। পীঠনির্ণয়তন্ত্র অনুসারে কেতুগ্রামে ভগবান বিষ্ণুর সুদর্শন চক্র দ্বারা খণ্ডিত খন্ডিত সতীর বাম বাহু পতিত হয়। এই পীঠে দেবীর ভৈরবের নাম ভীরুক বা ভূতনাথ।
“বহুলায়াং বামবাহু বহুলখ্যা চ দেবতা।
ভীরুকঃ ভৈরবস্তত্রঃ সর্বসিদ্ধিপ্রদায়ক“
কেতুগ্রামের আদি নাম বহুলা বা বাহুলা। পরে রাজা চন্দ্রকেতুর নাম অনুসারে হয় কেতুগ্রাম। রায়গুণাকর কবি ভারতচন্দ্র রায় অন্নদামঙ্গল কাব্যে লিখেছেন:
–“বহুলায় বামবাহু ফেলিল কেশব।বহুলা চন্ডিকা তায় ভীরুক ভৈরব।“
প্রানতোষণী তন্ত্রেও এই ভৈরবের নাম পাওয়া যায়।
এই কেতুগ্ৰামে অজয় নদের তীরে দেবী বিরাজিতা বহু প্রাচীন কাল থেকে। তবে সেই প্রাচীন মন্দির সময়ের নিয়মেই আর নেই। নতুন দেবীমন্দির ও নাট মন্দির নির্মাণ করা হয়েছে। নতুন মন্দিরে সেই প্রাচীন কষ্টিপাথরে নির্মিত দেবী বহুলার মূর্তিটি প্রাচীন ও নবীনের যোগসূত্র। দেবীর ডানপাশে অষ্টভুজ গনেশ। সম্ভবতঃ রাজা চন্দ্রকেতুই কার্তিক এবং গণেশসহ দেবীর পাথর মূর্তি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। অন্নদামঙ্গল গ্রন্থে এটিকে আবার “বাহুলা” পীঠ বলে উল্লেখ করা আছে এবং এখানের অধিষ্ঠিত দেবীকে “বাহুলা চণ্ডিকা” বলা হয়েছে। আবার “শিবচরিত গ্রন্থ” অনুযায়ী কেতুগ্রামেরই ‘রণখণ্ড’ নামে একটি জায়গায় সতীর ‘ডান কনুই’ পড়েছে। এখানে অধিষ্ঠিত দেবীর নাম বহুলাক্ষী ও ভৈরব মহাকাল। এখানে কোনও ভৈরবের মন্দির নেই। ভক্তদের বিশ্বাস, দেবীমূর্তির ভিতরেই তাঁর ভৈরব ভীরুক বিরাজ করছেন। আবার কিছু মানুষের বিশ্বাস কেতুগ্রাম থেকে তিন কিমি দূরে শ্রী খণ্ড গ্রামে প্রতিষ্ঠিত ভূতনাথ শিব হলেন মা বহুলার ভৈরব ভীরুক। কারণ ভৈরব প্রণাম মন্ত্রে বলা হয়– ”নমস্তে ভীরুকায় ভূতনাথ নাম ধারিনে। বহুলাক্ষী ভৈরবায় সদা শ্রীখন্ড বাসিনে”। গাজনের সময় তন্ত্র মতে এখানে ভূতনাথের পুজো হয় ও গাজনের সময় জাঁক জমক সহকারে উৎসব হয়।এই মন্দির থেকে সরু আলপথ ধরে ধান ক্ষেতের মধ্য দিয়ে এক কিলোমিটার পথ চললে আসে মরাঘাট নামে একটি জায়গা। প্রায় মজে যাওয়া এক নদীর তীর। এখানেই যুগ্মপীঠের অপর পীঠটি অবস্থিত। শিবচরিত মতে এখানে দেবীর ডান কনুই পড়েছিল। এই স্থানটির অপর নাম রণখণ্ড। দেবীর নাম বহুলাক্ষী। এবং দেবীর ভৈরব হলেন মহাকাল শিব। “মরাঘাট“- এই নাম থেকেই বোঝা যায় যে এখানে আগে শ্মশান ছিল। এখানে কিন্তু দেবীর কোনও মূর্তি নেই। ঘটেই দেবীর নিত্য পুজো হয়ে থাকে। এই মন্দিরের পাশেই রয়েছে পীঠ ভৈরব মহাকাল শিবের মন্দির। অনেকের মতে এই কেতুগ্রামেই জন্মেছিলেন নানুরের বিশালাক্ষী–বাশুলি দেবীর উপাসক চন্ডীদাস। এই গ্রামে ছিল তাঁর আদি বাসস্থান। এই কেতুগ্রামের উত্তরদিকের একটি জায়গাকে স্থানীয় মানুষজন চন্ডীভিটা বলে সম্বোধন করে থাকে। কালী সাধনার জন্য বহু তন্ত্রসাধকদের আগমন ঘটে এই সতীপীঠে। মূর্তি ছাড়াই মা‘কে পুজো করা হয় কালিকা পুরাণে রচিত দেবীর বীজমন্ত্র সহ। জনশ্রুতি প্রচলিত রয়েছে যে বহু সন্তানহীন দম্পতিরা মায়ের কাছে প্রার্থনা করে সন্তান লাভ করেছেন। সহস্রাধিক বছর ধরে এই যুগ্ম পীঠে মা কালী এবং মা দুর্গা রূপেই পূজিতা হয়ে আসছেন অত্যন্ত জাগ্ৰত দেবী মা বহুলা বা বাহুলাক্ষী।
• কোগ্রাম উজানী, পূর্ব বর্ধমান– দেবী মঙ্গলচণ্ডী , সতীপীঠ উজানি বা সতীপীঠ মঙ্গলচণ্ডী অবস্থিত বর্ধমান জেলার কোগ্রামে। বলা হয়, এখানে দেবীর ডান হাতের কনুই পড়েছিল। এখানে অধিষ্ঠিত দেবী মঙ্গলচণ্ডী এবং ভৈরব কপিলেশ্বর বা কপিলাম্বর। রাঢ় বাংলার অন্যতম উল্লেখযোগ্য প্রাচীন শক্তিপীঠ এটি। এই সতীপীঠে প্রচারের আলো পড়েছে খুব কম। অল্প মানুষই হয়তো এই পীঠের কথা জানেন।
বর্ধমান থেকে গুসকরা রোডে যেতে ডানদিকে কিছুদূর গিয়ে মাটির আলপথ ধরে এগোলেই দেবী মঙ্গলচণ্ডিকার মন্দির।পীঠনির্ণয়তন্ত্র মতে “উজ্জয়িন্যাং কর্পূরঞ্চ মাঙ্গল্যঃ কপিলাম্বরঃ।
ভৈরবঃ সিদ্ধিদঃ সাক্ষাদ্দেবী মঙ্গলচণ্ডিকা।।“
আবার ভারতচন্দ্রের অন্নদামঙ্গল কাব্যেও রয়েছে —
“উজানীতে কফোণি মঙ্গলচণ্ডী দেবী।
ভৈরব কপিলাম্বর শুভ যারে সেবি।।“
এখানে অধিষ্ঠিত দেবীর নাম মঙ্গলচণ্ডী ভৈরব কপিলাম্বর বা কপিলেশ্বর। গ্রাম্য পরিবেশ বেষ্টিত এই পীঠের পিছনে বয়ে চলেছে অজয় নদ। দক্ষিণ দিক থেকে বয়ে আসা কুনুর নদী অজয়ের সঙ্গে মিশেছে পীঠের অদূরে। মঙ্গলকাব্যে এই স্থানটি ভ্রমরারদহ নামে পরিচিত। এই অঞ্চল থেকে বহু প্রত্নসম্পদ পাওয়া গিয়েছে। বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে প্রখ্যাত প্রত্নতত্ত্ববিদ রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় এই উজানি কোগ্রামে এসেছিলেন এবং এখান থেকে তিনি প্রাচীন একটি শান্তিনাথের জৈনবিগ্রহ উদ্ধার করে নিয়ে গিয়েছিলেন। এই স্থানটি একসময় শৈব, শাক্ত, বৌদ্ধ ও জৈনধর্মের মিলনস্থল হয়ে উঠেছিল।
উজানি নগর হল চণ্ডীমঙ্গল কাব্যের নায়ক শ্রীমন্ত সওদাগর–এর জন্মস্থান। আবার মনসামঙ্গল কাব্যের বেহুলার বাপের বাড়ি অর্থাৎ বেহুলার পিতা সায়বেনের বাড়িও ছিল উজানিতে। “কবিকঙ্কণ” মুকুন্দরাম চক্রবর্তী রচিত চণ্ডীমঙ্গলে এই দেবীর মাহাত্ম্য রচিত হয়েছে। চণ্ডীমঙ্গল দুটি ভাগে বিভক্ত– আখেটিক খণ্ড ও বণিক খণ্ড। বৃহদ্ধর্মপু্রাণের একটি শ্লোকেও এই দুটি কাহিনীরই ইঙ্গিত রয়েছে। আখেটিক খণ্ডের অন্তর্গত কালকেতু–ফুল্লরা আখ্যানে দেবী দ্বিভুজা, তার প্রতীক মঙ্গলঘট, পূজার উপচার মাঙ্গল্য ধানদূর্বা।অন্যদিকে বণিকখণ্ডের উপাখ্যান অনুযায়ী– বণিক শ্রীপতি সদাগর ছিলেন পরম শৈব। তাই তিনি দেবী মঙ্গলচণ্ডীর পূজা করতে অস্বীকার করেন। অন্যদিকে ইন্দ্রের রাজসভার নর্তকী রত্নমালা দেবরাজ কর্তৃক শাপগ্রস্ত হয়ে মর্ত্যে শ্রীপতি সদাগরের প্রথম পত্নী লহনার খুড়তুত বোন খুল্লনারূপে জন্ম নেন। খুল্লনার সঙ্গে শ্রীপতির দ্বিতীয় বিবাহ হয়। বিবাহের পর প্রথম পত্নী লহনা তাঁর দাসী দুবলার কুপরামর্শে খুল্লনাকে প্রতিদিন ছাগল চড়াতে যেতে বাধ্য করেন। খুল্লনা তখন দেবী মঙ্গলচণ্ডিকার আরাধনা করে। তার পূজায় দেবী প্রসন্ন হন ও তাকে সমস্ত বিপদ থেকে রক্ষা করেন।
শ্রীপতি সওদাগর সিংহলের উদ্দেশে বাণিজ্যযাত্রায় রওনা হন। খুল্লনা তাকে মা চণ্ডীর আরাধনা করতে বললে তিনি অস্বীকার করেন এবং মা মঙ্গলচণ্ডীর ঘটে পদাঘাত করেন। রুষ্ট দেবী তাঁকে শাস্তি দেওয়ার মানসে সিংহলের বন্দরের কাছাকাছিই হস্তীভক্ষণ ও উগলরত (হাতি গিলে নিয়ে আবার মুখ থেকে বের করে দেওয়া) ষোড়শী কমলেকামিনী রূপ দর্শন করান। কিন্তু দেবীর মায়ায় অন্য কোন নাবিক কিন্তু এই দৃশ্য দেখতে পায় না।
এরপর সিংহলে উপস্থিত হয়ে সিংহলরাজের নিকট তিনি কমলেকামিনীর বর্ণনা করলে, রাজা তাকে অনুরোধ জানান রাজাকেও দেবীর সেই রূপ দর্শন করানোর জন্য। শ্রীপতি রাজাকে কমলেকামিনী দর্শন করাতে ব্যর্থ হলে রাজা তাকে কারারুদ্ধ করলেন।এদিকে পিতার সন্ধানে শ্রীপতি–পুত্র শ্রীমন্ত সিংহলের উদ্দেশে যাত্রা করেন। দেবীর মায়ায় তিনিও কমলেকামিনী রূপদর্শন করেন এবং সিংহলের রাজার কাছে বর্ণনা করে সেই রকম বিপদে পড়েন।
এবার ক্রোধান্বিত রাজা তাঁকে প্রাণদণ্ডের আদেশ দেন। বন্দী হয়ে কারাগারে তিনি দেবী চণ্ডীর বন্দনা করতে লাগলেন। তুষ্ট দেবীর কৃপায় রাজা শ্রীমন্তকে মুক্তি দিয়ে কন্যা সুশীলার সঙ্গে তাঁর বিবাহ দেন। পুত্র শ্রীমন্তর প্রয়াসে সিংহলের কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়ার পর শ্রীপতি সওদাগর দেবীর মহিমা স্বীকার করতে বাধ্য হন। এরপর তিনি উজানি ফিরে এসে দেবী মঙ্গলচণ্ডীর মন্দির তৈরি করেন। এইভাবে দেবীর পূজা মর্ত্যে প্রচারিত হয়। এই দেবী মঙ্গলচন্ডী সদগোপ রাজা বিক্রমজীত ঘোষের আরাধ্যদেবী ছিলেন যিনি মোঘলদের কে ১৭ বার মঙ্গলকোটে যুদ্ধে পরাজিত করেছিল । এখানে দেবী মঙ্গলচণ্ডী মহিষমর্দ্দিনী ও ভৈরব কপিলাম্বর বা কপিলেশ্বর। এখানে দুর্গাপূজা, কালীপুজো সবই হয়, তবে কোনও আলাদা মূর্তিতে নয়, দেবীর যে কষ্টিপাথরের মূর্তি আছে সেই মূর্তিতেই। এটি সতীপীঠ হওয়ার কারণে দুর্গাপুজোয় আলাদা করে মূর্তি আসে না এবং নবপত্রিকা আনা হয় না। শুধু নতুন ঘট আনা হয়। বছরে তিনবার এই ঘট বদল হয়। প্রথম ঘট আসে বৈশাখের শেষ মঙ্গলবার এবং সেই সময় বাৎসরিক পুজো হয়।
এরপর ঘট আসে জিতাষ্টমীর পরদিন, যাকে বোধনের ঘট বলা হয়। তারপর ঘট আসে দুর্গাপুজোর ষষ্ঠীর দিন। এছাড়াও বৈশাখ ও জ্যৈষ্ঠ মাসের মঙ্গলবারে মঙ্গলচণ্ডীর পুজো হয়। এখানে বলিপ্রথা চালু আছে। দুর্গাপুজোর সপ্তমী এবং অষ্টমীতে চালকুমড়ো, নবমীতে চালকুমড়ো, কলা, আখ এবং ছাগ বলি হয় সারাবছর দেবীর অন্ন, ভাজা, ডাল, পায়েস, মাছ ইত্যাদি সহকারে ভোগ হয়। কেবলমাত্র দুর্গাষ্টমীর দিন দেবীকে নিরামিষ ভোগ দেওয়া হয়।
মা এখানে দশভূজা দুর্গা। আগে মায়ের বিগ্রহ ছিল অষ্টধাতু নির্মিত। কিন্তু সেটি চুরি হয়ে যায়। এরপর কিছুদিনের জন্য ছবিতে মায়ের পুজোপাঠ চলত। পরে ১৯৯৪ সালে কবি কুমুদ রঞ্জন মল্লিকের পরিবারের সদস্যরা বর্তমানের কষ্টিপাথরের বিগ্রহ গড়ে দেন। উল্লেখ্য, এই কোগ্ৰাম কবি কুমুদ রঞ্জন মল্লিকের জন্মস্থান। বর্তমানে রায় পদবির ব্রাহ্মণরা এই মন্দিরের সেবায়েত। মন্দিরেই রয়েছে মায়ের ব্রহ্মশীলা। দেবীর ভৈরব কপিলাম্বর দেবীর পাশেই বিরাজমান। ভৈরবের পাশে রয়েছে একটি বজ্রাসন বৌদ্ধমূর্তি। ইতিহাসবিদদের ধারণা এই মূর্তিটি পাল সাম্রাজ্যের সময়ের।মন্দিরের পাশেই রয়েছে নাটমন্দির। সুন্দর বাগানসহ নতুন করে সাজিয়ে তোলা হয়েছে মন্দিরকে। গ্রামের একবারে শেষ প্রান্তে নিরিবিলি নদীর ধারে মন্দির হওয়ায় এই মন্দিরের পরিবেশ ভারী শান্তিময়। গ্রামের জনবসতি খুব বেশি নয়। দিনের শেষে যখন অজয়ের বাঁকে সন্ধ্যা নেমে আসে, দেবীর সন্ধ্যারতির কাঁসর বেজে ওঠে। শঙ্খ, ঘন্টার আওয়াজে মুখরিত হয়ে ওঠে অজয় নদের দুই তীর। মা মঙ্গলচণ্ডী মঙ্গলময়ী রূপে প্রতিনিয়ত তার সন্তানদের রক্ষা করে চলেছেন এই দেবীপীঠ উজানিতে।
• কিরীটেশ্বরী, মুর্শিদাবাদ – দেবী কিরীটেশ্বরী , এই সতীপীঠ মুর্শিদাবাদ জেলার কিরীটকণা গ্রামে অবস্থিত। পুরাণ বলে, এখানে দেবী সতীর মাথার মুকুটের একটি অংশ পড়েছিল। আবার কেউ কেউ বলেন, এখানে পড়েছিল দেবীর করোটির অংশ। এখানে অধিষ্ঠিত দেবী বিমলা এবং ভৈরব সংবর্ত। মুর্শিদাবাদ জেলার একমাত্র সতীপীঠ হল দেবী কিরীটেশ্বরী মন্দির। মুর্শিদাবাদ জেলার লালবাগ কোর্ট স্টেশন থেকে মাইল তিনেক দূরে কিরীটকণা‘ (বা ‘কিরীটকোণা‘) গ্রামে এই সতীপীঠ। দেবী সতীর কিরীট বা মুকুট পড়েছিল বলেই এই গ্ৰামের নাম হয়েছিল কিরীটকোণা। রাঢ় বাংলার প্রাচীন পীঠস্থানগুলির মধ্যে অন্যতম এই কিরীটকোণা। মন্দিরে দেবীর কোনও প্রতিমা নেই, একটি উঁচু পাথরের বেদী, সেই বেদীর উপর আরেকটি ছোট বেদী আছে। এই ছোট বেদীটিকেই দেবীর কিরীট বা মুকুট রূপে পূজা করা হয়। এই মন্দিরটির বয়স প্রায় দু’শো বছর। এই পীঠে দেবী ‘বিমলা‘ এবং তাঁর ভৈরব ‘সম্বর্ত‘ নামে পূজিত হন। পীঠ নির্ণয়তন্ত্রে এই পীঠকে “দ্বাবিংশতম” বা বাইশতম পীঠ বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
“ভুবনেশী সিদ্ধিরূপা কিরিটস্থা কিরীটতঃ
দেবতা বিমলা নাম্নি সংবর্তো ভৈরবস্তুথা“……
মহানীল তন্ত্র অনুযায়ী এই পীঠকে একটি মহাপীঠের মর্যাদা দেওয়া হয়েছে।
“কালীঘট্টে উহ্যকালী কিরীটেচ মহেশ্বরী
কিরীটেশ্বরী মহাদেবী লিঙ্গাখ্যে লিঙ্গবাহিনী”
এখানে দেবী কিরীটেশ্বরীর দুটি মন্দির আছে। রানী ভবানী প্রতিষ্ঠিত পুরনো মন্দিরটির এখন ভগ্নদশা। এই মন্দিরের চূড়া অদ্ভুতভাবে মাঝখান বরাবর দ্বিখণ্ডিত হওয়া। জনশ্রুতি, মহারাজা নন্দকুমার দেবী কিরীটেশ্বরীর ভক্ত ছিলেন। তার ইংরেজরা অন্যায় ভাবে ফাঁসি দিলে মন্দিরের চূড়া নাকি দ্বিখণ্ডিত হয়ে যায়। নতুন দেবীমন্দির নির্মাণ করিয়েছিলেন রাজা রাজবল্লভ। নতুন মন্দিরের চারিদিকে অনেক ছোট–ছোট মন্দির আছে। পাঠান–মুঘল শাসনকালেও এই পীঠস্থান তীর্থস্থান হিসেবে খ্যাত ছিল। ১১৭৭ বঙ্গাব্দে বিজয়রাম সেন রচিত ‘তীর্থ–মঙ্গল‘ কাব্যে কিরীটেশ্বরীর বর্ণনা আছেঃ
কিরীটেশ্বরী পূজা দিতে গেলা শীঘ্রগতি।
কথোগুলি বাত্রী গেলা কর্ত্তার সংহতি।।
মহাসরঞ্জাম সঙ্গে গিয়া কিরীটকোণা।
দেবীকে প্রণাম কৈল দিয়া কিছু সোনা।।
ষোড়শোপচারে পূজা কৈল ভগবানে।
দক্ষিণা করিলা কত কৈল বিতরণে।।
পৌষ মাসের প্রতি মঙ্গলবার এখানে বার্ষিক পুজো হয়। দুর্গা অষ্টমীর দিন দেবীরূপ পাথরখণ্ডটির পুরানো বস্ত্র ফেলে দিয়ে নতুন কাপড়ে আচ্ছাদিত করা হয়। দেবীর পূজা হয় দক্ষিনাকালীর ধ্যান মন্ত্রে। পাশেই দেবীর ভৈরবের মন্দির। রাজা রাজবল্লভের প্রতিষ্ঠিত শিবমন্দিরও এখানে আছে।
কিরীটকোণা গ্রামের কিছুটা ভিতরে গুপ্তমঠ নামে এক নতুন মন্দিরে নাকি দেবী কিরীটেশ্বরীর কিরিট বা মুকুটটি রাখা আছে। নাটোরের রানী ভবানীর পুত্র রাজা রামকৃষ্ণ বড়নগর থেকে এখানে আসতেন মায়ের সাধনা করতে। এখনও মন্দির–প্রাঙ্গনে দুটি পাথরখণ্ড দেখা যায়, যার উপর বসে রাজা রামকৃষ্ণ সাধনা করতেন।
এই কিরিটকোনা ধাম আরও সুপরিচিত নবাব সিরাজউদ্দৌলার মাতামহ বাংলার নবাব আলীবর্দি খানের জন্য, যিনি প্রত্যেক বছর, দোল যাত্রা বা বসন্ত উৎসব উপলক্ষে হিন্দুদের সঙ্গে আবীর দিয়ে রং খেলতেন। কথিত আছে মুর্শিদাবাদের নবাব মীরজাফর শেষ জীবনে কুষ্ঠরোগগ্রস্ত হলে তার হিন্দু দেওয়ানের পরামর্শ অনুযায়ী কিরীটেশ্বরী দেবীর চরণামৃত পান করায় তার রোগ নিরাময় হলে তিনি মন্দিরের নিকটস্থ দিঘির সংস্কার করিয়ে দিয়েছিলেন।
স্থানীয় মানুষরা বলেন দেবী অতি জাগ্ৰতা। মন থেকে প্রার্থনা করলে মা কখনও তাঁর ভক্তদের ফিরিয়ে দেন না। হাজার বছর ধরে এই পীঠস্থানে বিরাজ করছেন দেবী কিরীটেশ্বরী মাতা।
• পাণ্ডুয়া (প্রদ্যুম্ন), হুগলি – দেবী শৃঙ্খলা ,পাণ্ডুয়াকে সেখানে পুন্ডর নামে চিহ্নিত করা হয়েছে। দেবী হলেন সর্বাক্ষিণী ও ভৈরব হলেন সর্ব। এখানে দেবীর পেট পতিত হয়েছিল । মুসলিম আক্রমণে বর্তমানে ধ্বংস হয়ে গেছে।বর্তমানে এই স্থানটি ভারতের প্রত্নতাত্ত্বিক সমাজের সুরক্ষায় রয়েছে। ধ্বংসাবশেষের অবশিষ্টাংশের দরজা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে এবং মন্দিরে প্রবেশ নিষিদ্ধ। প্রত্নতাত্ত্বিক সমিতি বলেছে যে এটি নিরাপত্তার কারণে।
শ্রীঙ্কলা শব্দের দুটি অর্থ রয়েছে। প্রথম অর্থ হল, বাঁধন সুতো বা বাঁধন শৃঙ্খল, দ্বিতীয় অর্থ হল, একটি কাপড় যা প্রসবোত্তর মহিলারা তাদের পেট শক্ত করে বাঁধার জন্য ব্যবহার করেন বিশ্বাস করা হয়, ঋষ্যশৃঙ্গ নামের এক সাধক মা শৃঙ্খলা দেবীর মন্দির এই প্রদ্যুম্ননগর(বর্তমানে পাণ্ডুয়া) তে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। পাল ও সেন যুগের লেখালেখিতেও হুগলির পাণ্ডুয়ায় এই মন্দিরের উল্লেখ পাওয়া যায়। ১৩৪০ খ্রিষ্টাব্দে এই অঞ্চল শাসন করতেন পাণ্ডুরাজ নামের এক রাজা। এবং তার সাম্রাজ্যে গোহত্যা ছিলো দণ্ডনীয় অপরাধ। একই সময়ে দিল্লিতে চলছে মুসলিম শাসন, সেখানে ফিরোজ শাহ তুঘলকের ভাইপো শাহ সফিউদ্দিন বাংলা পরিক্রমণে আসেন পান্ডুয়ায়, এবং নিজের ছেলের খৎনা অনুষ্ঠান করে সেখানে জানা সত্বেও গোরু জবাই করে! এই কোথা পাণ্ডুরাজের কানে পৌছালে উনি সৈন্য পাঠিয়ে অনুষ্ঠান বন্ধ করিয়ে দেন। এতে ফিরোজ শাহ তার ভগ্নীপতি জাফর খান গাজীকে আদেশ দেন সেনা নিয়ে পাণ্ডুয়া আক্রমণ করতে এবং এখানকার সব হিন্দু মন্দির ভেঙ্গে ফেলতে। জাফার খান, সফিউদ্দিন নের্তৃত্বে সৈন্য আক্রমণ করলেও তারা হারতে থাকে, কিন্তু যখন তারা শোনে, পাণ্ডুয়ায় এই শৃঙ্খলা শক্তিপীঠে রাজা প্রতিদিন সকালে পুজো না দিয়ে যুদ্ধ করেন নাহ তখন তারা মন্দিরে গরুর মাংস ফেলে দে ও গোরক্ত দিয়ে শৃঙ্খলা বিগ্রহকে স্নান করায়। রাজার কানে এটি পৌছালে রাজা মন্দির পরিক্রমণে যেতেই সুযোগ নিয়ে তারা রাজার সৈন্যকে হারিয়ে দেয় ও শৃঙ্খলা শক্তিপীঠ ভেঙ্গে সেখানেই নীচের ছবির পাণ্ডুয়া মিনারটি তৈরী করে। সেই সন্ত্রাসী সফিউদ্দিনের মাজার ও আছে পাশেই, আছে মন্দিরের কাঠামোর উপর নির্মিত বাইশ দরওয়াজ মসজিদ। মিনারের গেটে আজও হিন্দু দেবদেবীর ভাস্কর্য আছে।
• রত্নাবলী, খানাকুল, হুগলি জেলা– দেবী কুমারী , এটি হুগলি জেলার খানাকুলে অবস্থিত। কথিত আছে, এখানে দেবী সতীর ডান কাঁধ পড়েছিল। এখানে অধিষ্ঠিত দেবী হলেন ‘কুমারী’ এবং ভৈরবকে বলা হয় ‘ঘণ্টেশ্বর’। তবে এই সতীপীঠে দেবীর থেকে প্রভাব বেশি ভৈরবের। শিবপুরাণ অনুসারে এখানে মায়ের দক্ষিণ স্কন্ধ বা ডান কাঁধ পড়েছিল। রত্নাকর নদীর নামানুসারে মায়ের নাম হয়েছিল দেবী রত্নাবলী। এখানে দেবীর ভৈরব বা পীঠরক্ষক হলেন ঘন্টেশ্বর শিব, ভক্তরা যাকে ভালোবেসে ‘বাবা ঘন্টেশ্বর’ বলে ডাকেন। এই সতীপীঠ স্থানীয়ভাবে ‘আনন্দময়ী শক্তিপীঠ’ নামে পরিচিত।দেবী এখানে মুণ্ডমালিনী, চতুর্ভুজা ও দিগম্বরী। তাঁর দুই বাম হাতের একটিতে রয়েছে খাঁড়া। অন্যটিতে অসুরের মাথা। দুই ডান হাতে অভয় মুদ্রা। দেবীর মাথায় রয়েছে মুকুট আর গলায় হার। এই পীঠে দেবী এবং ভৈরবের নিত্যসেবার ব্যবস্থা রয়েছে। ফল, মিষ্টির সঙ্গেই নিত্যসেবায় থাকে অন্নভোগও। সন্ধ্যার সময় দেবী ও ভৈরবের আরতি হয়। আশ্বিন ও চৈত্র মাসের নবরাত্রি, দীপান্বিতা অমাবস্যা, কার্তিক অমাবস্যা, মাঘের রটন্তী চতুর্দশী, মহাশিবরাত্রিতে এখানে বিশেষ পুজো হয়। গাজনের মেলাও বসে এখানে।
পীঠনির্ণয়তন্ত্র মতে এখানে দেবীকে ‘কুমারী‘ হিসাবে পূজা করা হয়। মনে করা হয় মা এখানে খুবই জাগ্রত। দেবীর মন্দিরের কাছেই নদীর তীরে শ্মশান। এই শক্তিপীঠে সাধক রামপ্রসাদের গুরুদেব কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ তন্ত্র সাধনা করতেন। মায়ের মূর্তি এখানে অনন্য সুন্দর।
মন্দিরের ইতিহাস আলোচনা করে জানা যায়, আগে এখানে বাবা ঘণ্টেশ্বর প্রতিষ্ঠিত হন, মা রত্নাবলী পরে আসেন। এপ্রসঙ্গে জনশ্রুতি রয়েছে যে অনেককাল আগে খানাকুলের কাছাকাছি এক গ্রামের বাসিন্দা বটুক কারকের বাড়িতে একটি গরু ছিল। সেই গরুটি বাড়িতে কখনও দুধ দিত না কিন্তু খানাকুলের এই অঞ্চলে একটি শিমূল গাছের পাশে এসে দুধ দিত। প্রতিদিন এই ঘটনা ঘটতে দেখে বটুকবাবুর মন কৌতূহলী হয়ে ওঠে। একদিন তিনি শিমূল গাছের পাশে ওই নির্দিষ্ট জায়গাটি চিহ্নিত করে সেখানে ভূমিতে খনন কাজ শুরু করেন। কিছুটা খোঁড়ার পরেই একটি শিবলিঙ্গ খুঁজে পেলেন তিনি। সেই শিবলিঙ্গটিই “ঘন্টেশ্বর শিব” রূপে প্রতিষ্ঠা করা হল।
আনুমানিক ৭১২ সালে খানাকুলে প্রতিষ্ঠিত হয় ঘন্টেশ্বর শিবমন্দির। তার দু‘বছর পর অর্থাৎ ৭১৪ সালে ওই অঞ্চলে আসেন বর্ধমানের জমিদার বংশের সন্তান স্বরূপ নারায়ণ ব্রহ্মচারী। তিনি ধ্যানে বসে জানতে পারেন ওই অঞ্চলেই পড়েছে সতীর দক্ষিণ স্কন্ধ বা ডান কাঁধ। একদিন গভীর রাতে শিমূল গাছের পাশে যেখান থেকে বাবা ঘন্টেশ্বরকে পাওয়া গিয়েছিল সেই একই জায়গায় একটি আলোর রেখা দেখতে পেলেন স্বরূপ নারায়ণ।
এরপর সেই স্থানে গিয়ে একটি প্রস্তর খণ্ড পান তিনি। মনে করা হয় এটিই ছিল দেবী সতীর ডান কাঁধ। পাথরে পরিণত হওয়া সেই খণ্ডটি অর্থাৎ। সতীর দক্ষিণ স্কন্ধটি মঙ্গলঘটের নীচে রেখে এরপর মা কালীর মূর্তি প্রতিষ্ঠা করলেন সাধক স্বরূপ নারায়ণ ব্রহ্মচারী। তখন থেকেই দেবীর পূজা হয়ে আসছে। আজও একইভাবে পূজিতা হন মা রত্নাবলী আনন্দময়ী। জানা যায় প্রতিষ্ঠার সময় এই মন্দিরটি ছিল একটি তালপাতার কুঁড়েঘর। বহু বছর পর বর্ধমানের মহারাজা এই পাকা মন্দিরটি নির্মাণ করিয়েছিলেন।
এখানে মাকে প্রত্যেকদিন মিষ্টি, ফল ও অন্নভোগ দিয়ে পুজো করা হয়। এই পীঠের কুণ্ডের জল খুব পবিত্র বলে ভক্তদের বিশ্বাস। বেলপাতার বদলে নারকেল দিয়ে এখানে ভৈরব ঘন্টেশ্বর মহাদেবের মানত করা হয়। প্রতি অমাবস্যায় এই মন্দিরে ঘটা করে পুজো হয়। রাজ্য এবং ভারতের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ভক্তরা এই শক্তিপীঠ দর্শন করতে এবং পুজো দিতে আসেন। অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে বেশ কড়া নিয়মকানুন মেনে এখানে পুজো করা হয়। অমাবস্যা তিথিতে, দুর্গা পূজার সময় এবং নবরাত্রির সময় ভক্তদের ভিড়ও হয় চোখে পড়ার মতো। হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের কাছে পরম পবিত্র জায়গা এই সতীপীঠ।
• তমলুক (তাম্রলিপ্ত), পূর্ব মেদিনীপুর– দেবী বর্গভীমা ,পীঠ নির্ণয় গ্রন্থ অনুযায়ী ৫১ পীঠের প্রথম হল বর্গভীমা। এটি পশ্চিম মেদিনীপুরের তমলুকে অবস্থিত। বলা হয়, দেবীর বাঁ পায়ের গোড়ালি পড়েছিল এখানে। এ কথার উল্লেখ রয়েছে অন্নদামঙ্গল কাব্যেও। এখানে দেবী বর্গভীমা এবং ভৈরব সর্বানন্দ রূপে পূজিত হন। প্রাচীন নগর তাম্রলিপ্ত বর্তমানে তমলুক। মেদিনীপুর জেলার সবচেয়ে ইতিহাস প্রসিদ্ধ স্থান এই সহর। ঐতিহাসিক রমাপ্রসাদ চন্দ তমলুককে “বাঙালীর বিলুপ্ত মহিমার মহাপীঠ” আখ্যা দিয়েছেন। সহরের প্রাচীনত্ব সম্বন্ধে বলতে হয় যে, ব্রহ্ম, মার্কণ্ডেয়, পদ্ম, মৎস্য প্রভৃতি পুরাণে তাম্রলিপ্ত বা তমলুকের নাম উল্লেখিত রয়েছে। ব্রহ্মপুরাণে লিখিত আছে মহাদেব দক্ষযজ্ঞে ব্রহ্মার পুত্র প্রজাপতিকে নিহত করেন। ব্রহ্মহত্যার পাপে ছিন্ন মস্তক মহাদেবের হাতেই যুক্ত হয়ে থাকে। কিছুতেই তিনি এই মস্তক হস্তচ্যুত করতে না পেরে বিষ্ণুর শরণাপন্ন হন। বিষ্ণু বলেন –
“অথং তে কথয়িষ্যামি যত্র নশ্যতি পাতকং।
তত্র গত্বা ক্ষণান্মুক্তঃ পাপাদ্ভর্গো ভবিষ্যসি ।।”
অর্থাৎ যেখানে গমন করিলে পাপ বিনষ্ট হয় এবং মুক্ত হওয়া যায় সে কথাই এখন বলব। এর পরেই বিষ্ণুর উপদেশ –
“অস্তি ভারতবর্ষস্য দক্ষিণস্যাং মহাপুরী,
তমোলিপ্তং সমাখ্যাতং গূঢ়ং তীর্থ বরং বসেৎ।
তত্র স্নাত্বাচিরাদেব সম্যগেষ্যসি মৎ পুরীং,
জগাম তীর্থরাজস্য দর্শনার্থাং মহাশয়ঃ ।।”
ব্রহ্মপুরাণের এই শ্লোকে ভারতবর্ষের দক্ষিণে (এখন অবশ্য ভারতবর্ষের দক্ষিণে বললে অনেকে কন্যাকুমারীতে গিয়ে হাজির হতে পারেন) ‘তমোলিপ্ত’ নামে যে মহাপুরীর কথা উল্লেখ করা হয়েছে সেটাই প্রাচীন তাম্রলিপ্ত বা বর্তমান তমলুক বলে মনে করা হয়। বর্গভীমা দেবীর মন্দির শুধু তমলুকে নয় পার্শ্ববর্তী বহুদূর বিস্তৃত অঞ্চলের মানুষের কাছে অত্যন্ত জাগ্রত দেবী হিসাবে স্বীকৃত ও পূজিত। আমাদের দেশের বহু প্রাচীন দেব–দেবীর মন্দির সম্বন্ধেই নানা জনশ্রুতি ও লোককথা প্রচলিত রয়েছে। বর্গভীমার মন্দিরের ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম ঘটে নি। মন্দিরের নির্মানকাল ও প্রতিষ্ঠাতা নিয়েও একাধিক মত ও কাহিনী বিদ্যমান। এখানে দুটি কাহিনী তুলে ধরা হবে। প্রথমটি এই রকম – প্রাচীন ময়ূরবংশের রাজা গরুড়ধ্বজের সময়ে একজন জেলেকে শোলমাছ ধরতে পাঠান হয়। একদিন মাছ ধরতে না পারায় ক্রুদ্ধ হয়ে রাজা জেলেকে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেন। গরীব জেলে কোন রকমে জঙ্গলে পালিয়ে যায় এবং সেখানে ভীমাদেবীর সাক্ষাৎ লাভ করে। দেবী তাকে শোলমাছ ধরে শুষ্ক করে রাখতে বলেন এবং একটি বিশেষ কূপের জল ছিটিয়ে প্রয়োজন মত মাছগুলি বাঁচিয়ে তুলবেন বলে আশ্বাস দেন। রাজা সারা বছর মাছ পাচ্ছেন দেখে কৌতুহলী হয়ে জেলেকে এর রহস্য জিজ্ঞাসা করেন। জেলে সব কিছু খুলে বলায় কূপের সেই অমৃতবারির কথা প্রকাশ হয়ে পরে। এতে দেবী কুপিত হয়ে পাথরের মূর্তির রূপ ধরেন এবং কূপের মুখে উপবিষ্ট হয়ে মুখটি রুদ্ধ করে দেন যাতে কেউ সেই জল ব্যবহার করতে না পারে। রাজা তাম্রধ্বজ কূপের খোঁজ না পেয়ে পাথরের মূর্তির উপরেই মন্দির নির্মান করে দেন। দ্বিতীয়টি আখ্যানটিও কম রোমাঞ্চকর নয়। বহুকাল আগে ধনপতি নামে এক ধনাঢ্য বণিক বাণিজ্যপথে যাবার সময় তমলুকে নোঙর করেন এবং সেখানে একজন লোককে একটি সোনার পাত্র বয়ে নিয়ে যেতে দেখেন। জিজ্ঞাসা করে জানতে পারেন যে একটি কূপের জলের স্পর্শে পিতলের জিনিস সোনায় রূপান্তরিত হয়। বণিক তমলুকের সমস্ত পিতলের বাসন যোগাড় করে সোনায় পরিণত করে সিংহলে চলে যান। ফিরে এসে মন্দিরটি নির্মান করে দেন। তবে মন্দিরটির সঙ্গে কৈবর্ত বা জেলে সম্প্রদায়ের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কথা অনেকের রচনাতেই উল্লেখিত হয়েছে। হতে পারে, ভগ্নপ্রায় পরিত্যক্ত মন্দিরটিতে কৈবর্তরাই পূজার প্রচলন করেন এবং পরে কোন রাজা মন্দিরটির সংস্কার সাধন করেন। উল্লেখ করা যেতে পারে যে বহুদিনের প্রচলিত কাহিনী, জনশ্রুতি ও কিংবদন্তীতে বহু অতিরঞ্জন থাকে ঠিকই কিন্তু এগুলিই ইতিহাস রচনায় অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসাবে স্বীকৃত হয়েছে। এ প্রসঙ্গে কোণারকের সূর্য মন্দিরটির কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। সেখানে সমুদ্রের ধারে বালির নীচে যে একটি মন্দির চাপা পড়ে আছে, এটা জনশ্রুতি ছিল।
বর্গভীমা মন্দিরটি একান্ন পীঠের অন্তর্ভুক্ত কিনা এ নিয়ে মতভেদ আছে। অনেকে মনে করেন সতীর বাঁ–পায়ের গোড়ালি এখানে পড়েছিল এবং এটি পীঠস্থান। পঞ্জিকায় একান্ন পীঠের যে তালিকা রয়েছে তাতে ‘বিভাস’ বা ‘বিভাসক’–এর পাশে তমলুকের নাম উল্লেখ করা থাকে। কিন্তু এটি পরবর্তীকালে প্রক্ষিপ্ত বলে অনেকের মত। এর কারণ সম্ভবতঃ অষ্টাদশ শতাব্দীতে কবি ভারতচন্দ্রের রচিত ‘অন্নদামঙ্গলে’র দুটি পংক্তি –
“বিভাসেতে বাম গুলফ ফেলিয়া কেশব।
ভীমরূপা দেবী তাহে কপালী ভৈরব”।।
হয় ত ‘ভীমরূপা দেবী’ ও ‘বিভাস’ এই দুটি শব্দই ‘বিভাস’কে তমলুক হিসাবে গণ্য করে বর্গভীমা দেবীর মন্দিরকে এখানে প্রতিষ্ঠিত বলে মনে করতে সাহায্য করেছে। অনেকের মতে বিভাস নামক স্থানটি পেশোয়ারের কাছে অবস্থিত। ‘মেদিনীপুরের ইতিহাস’ রচয়িতা যোগেশচন্দ্র বসু মন্দিরটিকে একান্ন পীঠের নয় বলেই মনে করেন।
মন্দিরটি কবে নির্মিত হয়েছিল সে সম্বন্ধে সঠিক কোন দিশা পাওয়া যায় না। অনেকে মনে করেন ময়ূরবংশীয় রাজারাই এর প্রতিষ্ঠাতা। ময়ূরবংশের শেষ রাজা নিঃশাঙ্ক নারায়ণ নিঃসন্তান অবস্থায় মারা যান এবং পরাক্রমশালী ধীবর বংশীয় কালু ভুইঞা সিংহাসনে আরোহণ করেন। কালু ভুইঞাই ছিলেন কৈবর্ত বংশের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রথম নৃপতি। অনেকের মতে কৈবর্ত রাজারাই বর্গভীমা মন্দিরটি নির্মান করেছেন। ষোড়শ শতাব্দীতে ‘চণ্ডীমঙ্গল কাব্যে’র রচয়িতা মুকুন্দরাম চক্রবর্তী বর্গভীমা মন্দিরের উল্লেখ করেছেন –
“গোকুলে গোমতী নামা তমলুকে বর্গভীমা, উত্তরে বিদিত বিশ্বকায়া”।
মাণিকরাম গাঙ্গুলীর ‘ধর্মমঙ্গল’ কাব্যেও এরকম উল্লেখ পাওয়া যায় –
“বন্দির বেলার চণ্ডী ছাতনার বাসুলী।
তমলুকের বর্গভীমা রায়খার কালী।।”
তবে এ ত ষোড়শ শতাব্দীর কথা; মন্দিরের প্রতিষ্ঠা হয় ত এর অনেক আগেই হয়েছিল। নানা বিবরণ থেকে যেটা গ্রহণযোগ্য বলে মনে হয় সেটা হল –
বৌদ্ধধর্ম যখন বিস্তীর্ণ অঞ্চলে প্রভাব বিস্তার করেছিল তখন তমলুক ছিল বৌদ্ধধর্মের একটি পীঠস্থান। চীনদেশীয় পরিব্রাজকেরা মূলতঃ এই ধর্ম সম্বন্ধে জ্ঞান লাভ করতেই ভারতের অন্যান্য স্থানের সঙ্গে তমলুকেও এসেছিলেন। মহারাজ অশোকের সময় থেকে পাল রাজাদের সময় পর্যন্ত (অষ্টম থেকে দ্বাদশ খ্রিষ্টাব্দ) হীনযান ও মহাযান, বৌদ্ধধর্মের এই দুই মতই প্রচলিত ছিল। পাল সাম্রাজ্যের সময় থেকেই এই ধর্ম তন্ত্রশাস্ত্র দ্বারা প্রভাবিত হতে থাকে এবং তান্ত্রিক সিদ্ধপুরুষদের দ্বারা বৌদ্ধধর্ম কিছুটা রূপান্তরিত হয়, শাক্তমতের সঙ্গে কিছটা মিল খুঁজে পাওয়া যায়। এদিকে ব্রাহ্মণ্যধর্মের উত্থানে বৌদ্ধধর্ম স্তিমিত হয়ে পড়ে। বর্গভীমা মন্দিরের স্থানটি প্রথমে একটি বৌদ্ধ বিহার ছিল এবং বৌদ্ধধর্মের প্রভাব ক্ষীণ হয়ে আসায় বহুদিন পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে থাকে। সম্ভবতঃ পাল রাজাদের সময় বা তার কিছু পরে এখানেই বর্গভীমা দেবীর মূর্তি (তারা বা কালী) প্রতিষ্ঠিত হয়। বৌদ্ধগ্রন্থে দেবীকে ‘বজার ভীমা’ নামে সম্বোধন করা হয়েছে। ‘বজার ভীমা’ থেকেই হয় ত ‘বর্গভীমা’। এটা সত্যি হলে ধরে নিতে হয়, দেবী মূর্তি এখানে আগেই ছিল, পরে কোন রাজা বা ধানাঢ্য ব্যক্তি এটির সংস্কার সাধন করেছেন। দেবীর মন্ত্রটি হল –
“কৃষ্ণবর্ণাং চতুর্ভুজাং মুণ্ডমালা বিভূষিতাং।
দক্ষিণে খড়্গ শূলঞ্চ তীক্ষ্ণধারা দূরাসদম;
বামে খর্পর মুণ্ডঞ্চ লোলজিহ্বা ত্রিলোচনা।
ব্যাঘ্রচর্ম পরিধানাং ভীমাদেবী শবাসনা।।”
চতুর্ভুজা দেবীর ডানদিকের উপরের হাতে খড়্গ নীচের হাতে ত্রিশূল; বা–দিকের উপরের হাতে খর্পর ও নীচের হাতে অসুর–মুণ্ড। দেবীর পদতলে শিব। হান্টারের (W.W. Hunter : ‘A Statistical Account of Bengal’, Vol ৩, ১৮৭৬, London) বর্ণনায় দেখা যাচ্ছে – ডানদিকের উপরের হাতে ত্রিশূল, নীচে তলোয়ার; বা–দিকের উপরের হাতে তলোয়ার ও নীচে অসুর–মুণ্ড। তবে কি পরে হস্তধৃত বস্তুর পরবর্তন ঘটেছে? বর্গভীমা দেবীর মূর্তিটি একটি কালো পাথরের সম্মুখভাগ খোদাই করে বের করে আনা হয়েছে। ‘তমলুক ইতিহাস’ লেখক ত্রৈলোক্য নাথ রক্ষিত মহাশয়ের মতে – “এইরূপ প্রস্তরে কতকাংশ খোদিত মূর্ত্তি সচরাচর দেখিতে পাওয়া যায় না। ইহা উগ্রতারা মূর্ত্তির অনুরূপ। ইহার ধ্যান ও পূজাদি যোগিনী–তন্ত্র এবং নীল–তন্ত্রানুসারে হইয়া থাকে ।”
ভারতের নানা স্থানেই এক সময়ে বহু বৌদ্ধমঠ বা বিহার নির্মিত হয়েছিল। কালক্রমে বৌদ্ধধর্মের প্রভাব ক্ষীণ হয়ে এলে বহু মন্দির জীর্ণ পরিত্যক্ত অবস্থায় পরে থাকে। পরবর্তী সময়ে সেগুলির সংস্কার সাধন বা পুনর্নিমাণ করে হিন্দু মন্দির তৈরি হয়েছে এরকম বহু উদাহরণ রয়েছে। পুরীর বিখ্যাত জগন্নাথ মন্দির সম্বন্ধেও একই কথা প্রচলিত। এখানে ৪৮৩ খ্রীষ্ট পূর্বাব্দে একটি শিক্ষাকেন্দ্র গড়ে উঠেছিল (সম্ভবতঃ বৌদ্ধদের) বলে জানা যায়। বৌদ্ধধর্মের প্রভাব স্তিমিত হয়ে এলে দীর্ঘদিন পরে ১১৭৪ খ্রীষ্টাব্দে এখানে বর্তমান মন্দিরটি নির্মিত হয়।
বর্গভীমা মন্দিরের গঠনশৈলীর প্রশংসা অনেকেই করেছেন। হান্টারের বর্ণনা অনুযায়ী বড় বড় কাঠের গুড়ি বিছিয়ে তার উপর ইট ও পাথর দিয়ে ত্রিশ ফুট উচু ভিত তৈরী করা হয়েছে। এর উপরেই তৈরি হয়েছে মন্দিরের দেয়াল। তিনটি পৃথক দেয়ালের সমষ্টিতেই পূর্ণ দেয়ালটি নির্মিত। মধ্যের দেয়ালটি পাথরের তৈরি। এর উপরেই ষাট ফুট উচ্চতা বিশিষ্ট মন্দিরটি দণ্ডায়মান। মন্দিরের শীর্ষদেশে একটি বিষ্ণুচক্র ময়ূরাকৃতি কাঠামোর উপর স্থাপিত। মেদিনীপুরের ইতিহাস রচয়িতা যোগেশচন্দ্র বসু মন্তব্য করেছেন -“তমলুকের নিকট পর্ব্বতাদি কিছুই নাই, আর তৎকালে এখনকার মত রেল ষ্টীমারের সুবিধাও ছিল না। এরূপ অবস্থায় বহুদূর হইতে প্রস্তরাদি আনাইয়া এরূপ সুবৃহৎ মন্দির নির্ম্মান করা শিল্পনৈপুণ্যের যথেষ্ট পরিচায়ক।” পশ্চিমমুখী মন্দিরটি অন্যান্য অনেক মন্দিরের মতই চারটি অংশে বিভক্ত। প্রথমটি মূল মন্দির বা বড় দেউল, যেখানে দেবীমূর্তী দণ্ডায়মান। দ্বিতীয়টি অন্তরাল বা যোগমন্ডপ। এখানে দাঁড়িয়ে ভক্তরা দেবী দর্শন করেন। এ স্থানটি অপ্রশস্ত, বড় জোর আট দশ জন লোক দাঁড়াতে পারে। তৃতীয়টি জগমোহন বা যজ্ঞমন্দির, এখানে এক সময়ে যজ্ঞ ও হোম হত এবং চতুর্থ অংশটি অনেক পরে নির্মিত নাটমন্দির। নাটমন্দিরের তিন দিকই উন্মুক্ত হওয়ায় নাম সঙ্কীর্তন, পালাগান বা অন্যান্য ছোটখাট অনুষ্ঠানের উপযোগী। নাটমন্দির থেকে বেড়িয়ে একুশটি প্রশস্ত সিড়ি দিয়ে নেমে কিছুটা এগিয়ে লোক চলাচলের রাস্তায় গিয়ে পড়তে হয়। মন্দিরটি ‘রেখ দেউল’ রীতিতে তৈরি। উড়িষ্যায় এ ধরণের মন্দির বহু সংখ্যক থাকলেও বাংলাদেশে এর প্রচলন কম। এখানে মন্দির নির্মানে ‘বাংলা মন্দির’, ‘চালা মন্দির’ বা ‘রত্ন মন্দির’ রীতিই অনুসৃত হয়।মন্দিরের নির্মান কাল বা আনুষঙ্গিক বিষয় নিয়ে ঐতিহাসিক বিতর্ক যাই থাক, এতে দেবী মাহাত্ম্য কিছুমাত্র ক্ষুন্ন হয় না। তমলুক ও পার্শ্ববর্তী স্থানে ‘বর্গভীমা’ বা ‘ভীমা মা’ অত্যন্ত জাগ্রত দেবী বলেই খ্যাত এবং উপাসিত। দেবীর প্রভাব এতটাই কাজ করত যে মন্দিরের বাইরে একটি নির্দিষ্ট সীমানার মধ্যে অন্য কোন পূজা অনুষ্ঠিত হত না। এখন অবশ্য সেই প্রথার অবসান ঘটেছে। প্রচলিত রয়েছে যে, মারাঠারা যখন দক্ষিণবঙ্গে লুঠতরাজ ও ধ্বংসকার্য চালায়, তখন কিন্তু তারা তমলুকে এসে দেবী বর্গভীমাকে মূল্যবান দ্রব্যাদি শ্রদ্ধার্ঘ হিসাবে প্রদান করে। ষোড়শ শতাব্দীর মাঝামাঝি কালাপাহাড়ের আক্রমণ থেকেও মন্দিরটি রক্ষা পেয়েছিল। এমন কি রূপনারায়ণ নদীর বন্যাও মন্দির অবধি এসে থেমে যায় বলে জনশ্রুতি। মন্দির চত্বরে রয়েছে একটি বহু পুরাণো গাছ – চাঁপা, গুলঞ্চ, কেলিকদম্ব ইত্যাদি বিভিন্ন নামে গাছটির পরিচয়। কাছেই রয়েছে একটি কূপ (‘মায়ের কুন্ড’ নামে পরিচিত )। খাড়া সিড়ি দিয়ে নেমে জলস্পর্শ করা যায় কূপটির। প্রচলিত বিশ্বাস যে কোন নিঃসন্তান মহিলা খুব ভোরবেলা উঠে কারো মুখ না দেখে মন্দিরের কূপে হাত দিয়ে পাথর বা ইটের টুকরো যা হাতে আসে সেটাই তুলে এনে সেটিকে নিজের মাথার চুল দিয়ে বেধে গাছের গায়ে ঝুলিয়ে দিয়ে মন্দিরে প্রণাম করলে মনস্কামনা পূর্ণ হয়। গাছটির কাছে গেলে নানা আকৃতির ইট বা পাথরের টুকরো চুলে বাঁধা অবস্থায় ঝুলতে দেখা যেত। আমি ছোটবেলায় সেটাই দেখেছি; হান্টারের বইতেও চুল দিয়ে বাঁধার রীতিরই উল্লেখ রয়েছে। পরবর্তী সময়ে চুলের বদলে লাল সুতোর (ঘুনসি) প্রচলন হয়েছে। বিশেষ উপলক্ষে ছোট ছোট ঘটও বেঁধে রাখা হয়। ফল ফলে কি না জানা নেই, তবে কিছুই যদি না হয় তবে দীর্ঘকাল ধরে এই রীতি চলে আসছেই বা কি করে? আমি ১৯৪৯ সালে তমলুকে ছিলাম। তখন যা শুনেছি এবং যে ভাবে গাছটিকে দেখেছিলাম, কিছুদিন আগে গিয়েও একই জিনিস প্রত্যক্ষ করেছি। অবশ্য এখন মদিরটির অনেক সংস্কার সাধন করা হয়েছে। হান্টার সাহেবও তার বইতে গাছটি এবং সেটিকে ঘিরে উল্লিখিত কাহিনীর কথা লিখে গিয়েছেন। বইটি প্রকাশিত হয়েছে ১৮৭৬ সালে। তার পঞ্চাশ বছর আগেও যদি গাছটি থেকে থাকে তা হলেও দু’শ বছর ধরে একটা গাছ একই ভাবে দাঁড়িয়ে থেকে একটি বিশ্বাসকে বয়ে নিয়ে চলেছে এটা খুব সাধারণ ঘটনা নয়।
• ত্রিস্রোতা, জলপাইগুড়ি – দেবী ভ্রামারী ,এটি অবস্থিত জলপাইগুড়ি জেলায় তিস্তা নদীর তীরে। পুরাণ অনুযায়ী এখানে সতীর বাঁ পা পড়েছিল। এখানে অধিষ্ঠিত দেবী ভ্রামরী এবং ভৈরব হলেন ঈশ্বর। কথিত আছে, অরুণাসুরকে পরাজিত করতে দেবী দুর্গা অসংখ্য ভ্রমরের রূপ ধারণ করেন, সেখান থেকেই ভ্রামরী নামের আগমন।এই মন্দিরটি জলপাইগুড়ি জেলার বোদাগঞ্জ অথবা সাতকুড়া অঞ্চলে অবস্থিত। যদিও, এই মন্দির প্রতিষ্ঠার সঠিক তারিখ এখনও অজানা। কারন, এটি এমন একটি সতীপীঠ যা বহু শতাব্দী পূর্বে তৈরি হয়েছিল বলে জানা যায়। মন্দির চত্বরে জোরা বট গাছ খুব আকর্ষণীয়। লোক বিশ্বাস অনুযায়ী, এই সতীপীঠ খুবই জাগ্রত।
সতীরপীঠের মধ্যে অন্যতম হল সতীপীঠ ভ্রামরী। জলপাইগুড়ির তিস্তা নদীর তীরে শালবাড়ি গ্রামে অবস্থিত এই সতীপীঠ। এই মন্দিরটি নদীর তিন স্রোতের মধ্যে অবস্থিত বলে একে ত্রিস্রোতা মন্দিরও বলা হয়। বৈকুন্ঠপুরের জঙ্গলের মাঝে অবস্থিত মন্দিরকে অনেকটা সাপের মতো পেঁচিয়ে বয়ে চলেছে তিস্তা নদী। জনশ্রুতি অনুসারে, দেবী সতীর বাম চরণ পড়েছিল ত্রিস্রোতায়। দেবী এখানে ভ্রামরী নামে পূজিত হন। ভৈরবের নাম ঈশ্বর। দেবী ভ্রামরীও অন্যতম আদি শক্তি।
পীঠনির্ণয় তন্ত্র অনুযায়ী এটি ষোড়শ সতীপীঠ।
“ত্রিস্রোতায়াং বাম পাদো ভ্রামরী ভৈরবেশ্বর“
পীঠনির্ণয়তন্ত্র মতে, ত্রিস্রোতায় দেবী সতীর বাম চরণ পড়েছিল।
পুরাণের কাহিনী অনুযায়ী অরুণাসুর নামে এক ভয়ঙ্কর অত্যাচারী অসুর ছিল। তার আক্রমণে ত্রিলোক বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল। অরুণাসুরের বোন বজ্রজ্বালার বাসনা হয়েছিল যে সে চন্দ্রদেবকে বিবাহ করে তাঁর রাণী হয়ে থাকবে। কিন্তু চন্দ্রদেব তার বিবাহের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলে বোনের অপমানের শোধ নিতে অরুণাসুর ব্রহ্মার তপস্যা শুরু করে। তপস্যায় তুষ্ট ব্রহ্মা উপস্থিত হয়ে অরুনাসুরকে বর প্রার্থনা করতে বলেন। অসুর অমরত্ব প্রার্থনা করলে ব্রহ্মা রাজী হন না। তখন সে বর চায় যে কোনও দ্বিপদী বা চতুষ্পদী প্রাণী তাকে হত্যা করতে পারবে না। এরপর ভয়াবহ শক্তিশালী হয়ে অরুণাসুর কৈলাস আক্রমণ করলে শিবও তাকে পরাভূত করতে পারেননি। সে দেবতাদের পর্যন্ত বন্দী করল। শেষ পর্যন্ত শিবের ডাকে দেবী মহামায়া ভ্রামরী রূপে আবির্ভূত হয়ে বিশাল আকার ধারণ করেন। স্থির হয় ছয় পদ বিশিষ্ট ভ্রমরেরা তাঁর সৈন্য হিসাবে যাবে। দেবীর মহিমায় শত সহস্র ভ্রমর এবং অন্যান্য পতঙ্গ–আক্রমণে এবং দেবীর প্রহারে অসুর নিহত হয়। তারা অরুণাসুরকে দংশন করে ও তাকে সম্পূর্ণ ভক্ষণ করে। এরপর দেবতারা পুনরায় স্বর্গরাজ্যে প্রবেশ করেন। সেই ভ্রমরগুলি অলঙ্কারের মতো দেবীর দেহে অধিষ্ঠান করতে শুরু করে যা থেকে দেবীর নাম হয় ভ্রামরী।
এই শক্তিপীঠ খুবই জাগ্রত বলে মানুষের বিশ্বাস। দেবী এই পীঠস্থানে ভ্রমর পরিবেষ্টিত কালিকা রূপে বিরাজমানা। মন্দিরে প্রবেশ করলে প্রথমেই রয়েছে দেবীমূর্তি। এখানে দেবী সালঙ্কারা ও অষ্টভূজা। দেবীর সামনে রাখা বড় বড় কলসের উপর রয়েছে পুষ্পপত্র। তার পাশে রাখা আছে পিতলের তৈরি দেবীর চরণদ্বয়। এই চরণদুটিতেই পুজো করা হয়। মন্দিরে তাঁর দক্ষিণ পাশে অবস্থান করছেন দেবাদিদেব মহাদেব ও অনুচর নন্দী । সেই মন্দির কক্ষ থেকে কয়েকধাপ সিঁড়ি দিয়ে নীচে নামলেই পৌঁছে যাওয়া যায় ভ্রামরী মাতার মন্দিরের গর্ভগৃহে। যেখানে দেবী সিংহবাহনা। দেবীর গাত্র কৃষ্ণবর্না। তাঁর চার হাতে শোভিত রয়েছে গদা, ত্রিশূল, খড়্গ ও ঢাল । সামনের বেদীতেই থাকে দেবীর প্রস্তরীভূত বামপদ।
মূল দেবীমন্দিরে প্রবেশের মুখে রয়েছে সিদ্ধিদাতা গণেশের মূর্তি। মন্দিরে প্রবেশ করলে প্রথমেই রয়েছে দেবীমূর্তি। দেবী সালঙ্কারা ও অষ্টভূজা। দেবীর সামনে রাখা বড় বড় কলসের উপর রয়েছে পুষ্পপত্র। পাশে রাখা থাকে পিতলের তৈরি দেবীর চরণদ্বয়। যা পূজিত হয়। দেবীর ডান পাশে রয়েছে মহাদেবের মূর্তি। সেই কক্ষের থেকে কয়েকধাপ সিঁড়ি দিয়ে নীচে নামলেই পৌঁছে যাওয়া যায় ভ্রামরী মাতার মন্দিরের গর্ভগৃহে। যেখানে দেবী সিংহবাহনা। দেবীর গাত্র কৃষ্ণবর্না। সামনের বেদীতেই থাকে দেবীর প্রস্তরীভূত বামপদ।এখানে দেবীর গর্ভেশ্বরী এবং গর্তেশ্বরী নামে দুটি প্রাচীন মূর্তি আছে। কালিকাপুরাণে জল্পেশ–এর সিদ্ধেশ্বরী মা ভ্রামরী দেবীর উল্লেখ পাওয়া যায়। ঠিক কোন স্থানে সতীর পদ পতিত হয়েছিল এ নিয়ে ভিন্ন মত থাকলেও দুটি মন্দিরই দেবীর ভক্তদের কাছে অতি গুরুত্বপূর্ণ পুণ্যস্থান।
সিদ্ধপীঠ তারাপীঠ, বীরভূম – দেবী তারা , বীরভূমের রামপুরহাটের কাছে এই সতীপীঠে ভক্তদের সমাগম লেগেই থাকে। তবে অনেকেই একে সতীপীঠ হিসেবে মানেন না। তবে বলা হয় এখানে দেবীর তৃতীয় নয়ন পড়েছিল। এখানকার পীঠরক্ষক হলেন শিব যিনি চন্দ্রচূড় নামে পূজিত হন। সতীর ৫১ পীঠের এক পীঠ না হলেও সিদ্ধপীঠ হিসেবে তারাপীঠের জগৎ জোড়া নাম। মহাসাধক বামাখ্যাপার সাধনার এই পুণ্যস্থান আজ এক জাগ্রত তীর্থভূমিতে পরিণত হয়েছে। যুগ–যুগ ধরে বহু সাধকের সাধনায় পবিত্র হয়েছে তারাপীঠের মাটি। তাই তারাপীঠ এক সিদ্ধপীঠে পরিণত হয়েছে। জগজ্জননী উগ্রতারা এখানে সদা জাগ্রতা।
তন্ত্রসাধনার সকল লক্ষণ ও অনুকূল পরিবেশ নিয়ে প্রকৃতি এখানে মুক্তমনা। গ্রামের নাম চণ্ডীপুর। পাশ দিয়ে নিবিড় অরণ্যের বুক চিরে বয়ে চলেছে উত্তরবাহিনী দ্বারকা নদী। দ্বারকার পূর্বদিকে প্রায় এক ক্রোশ জুড়ে শ্মশান। তন্ত্রমতে, যে নদী উত্তরবাহিনী ও যেখানে জোয়ার–ভাটা হয় না তার তীরে যে শ্মশান তা মহাশ্মশান রূপে চিহ্নিত। চণ্ডীপুরের আর এক নাম তারাপুর বা তারাপুরী। পরবর্তীকালে তারাপীঠ নামে খ্যাত হয়েছে। কালের করাল গ্রাসে সেই নিবিড় অরণ্যের ছিটেফোঁটাও নেই আর আজকের তারাপীঠে। যে মহাশ্মশানে বসে বহু সাধক সাধনায় সিদ্ধিলাভ করেছেন সেই স্থানটিও এখন ক্রমশ কৌলীন্য হারাচ্ছে। ইট–কাঠের নির্মাণের দাপটে আর হোটেল–রেস্তোরাঁর ভিড়ে মহাশ্মশান আজ এক ছোট্ট বসতি এলাকায় পরিণত হয়েছে। তবে আজও এই মহাশ্মশানে প্রবেশ করলে ভক্তের মনে এক অন্যরকম অনুভূতির সঞ্চার হয়।
লোকশ্রুতি অনুযায়ী তারা মা–র বাস ছিল চিনে। মহামুনি বশিষ্ঠ দেব তাঁকে সন্তুষ্ট করতে শুরু করেন তপস্যা। সে দিন মায়ের ভোগে ছিল দুধ, ফল, মিষ্টি। সেই পুজোয় সন্তুষ্ট হননি তারা মা। বশিষ্ঠ মুনিকে তিনি জানান, সত্যিই তাঁকে সন্তুষ্ট করতে হলে তন্ত্র মতে পুজো করতে হবে। আর সেই পুজোর রীতিও আলাদা। স্বপ্নাদেশে মা জানান, বশিষ্ঠ মুনিকে যেতে হবে চিনে। সেখানে বুদ্ধরূপী জনার্দনের সঙ্গে দেখা করে শিখতে হবে তপস্যার রীতি–নীতি। বশিষ্ঠ মুনি চিনে গিয়ে দেখা করলেন বুদ্ধরূপী জনার্দনের সঙ্গে। শুরু হল মায়ের তপস্যার শিক্ষা। এই নিয়মে ছিল ‘পঞ্চ ম‘। তারা মায়ের পুজো তাই ‘পঞ্চ ম‘ ছাড়া হয় না। বুদ্ধরূপী জনার্দনের থেকে তন্ত্র মতে পুজো শিখে বশিষ্ঠ মুনি শুরু করেন তপস্যা। তপস্যায় সিদ্ধিলাভ করে মায়ের আদেশ পান, বরলাভও করেন। বর হিসাবে বশিষ্ঠ মুনি চেয়েছিলেন তারা মায়ের মাতৃরূপ দেখতে। সমুদ্রমন্থনের পর মহাদেব যখন বিষের জ্বালায় জর্জরিত, তারা মা সেই জ্বালা কমাতে মাতৃরূপে শিবকে বাম বক্ষের স্তন্যপান করান। মায়ের সেই সময়কার রূপই দেখতে চান বশিষ্ঠ মুনি। মুনির প্রার্থনা পূরণ করেন তারা মা। ‘তথাস্তু‘ বলে শিলায় পরিণত হন। সেই শিলা মূর্তিকে মায়ের ইচ্ছা অনুযায়ী প্রতিষ্ঠা করা হয় দ্বারকা নদীর ধারে।
আরেকটি জনশ্রুতি অনুযায়ী কথিত আছে, আশ্বিন মাসের শুক্লা চতুর্দশীর দিন মা তারা আবির্ভূত হয়েছিলেন। লোক মুখে প্রচলিত আছে, জয় দত্ত নামে এক বণিক নৌকা নিয়ে দ্বারকা নদী পার হচ্ছিলেন। সেই সময় তারাপীঠের কাছে নৌকা থামিয়েছিলেন। নোঙর করা নৌকায় বিষধর সাপের ছোবলে মৃত্যু হয় জয় দত্তের ছেলের। এদিকে জয় দত্তের লোকজন তখন অন্যদিকে খাবারের তোড়জোড় করছিলেন। তারা একটি শোলমাছ কেটে পুকুরে ধুতে যান। পুকুরের জলে মাছ ধুতেই সেই মাছ নাকি জ্যান্ত হয়ে উঠেছিল। অলৌকিক এই ঘটনার কথা তারা মালিক জয় দত্তকে জানালে তিনি মৃত ছেলেকে ওই পুকুরে নিয়ে যান। সেই পুকুরের জল গায়ে ঢালতেই মৃত ছেলে বেঁচে ওঠে। এই ঘটনা লোকের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ায় সেখানে ভক্তদের ভিড় জমতে থাকে। সেই পুকুর এখন তারাপীঠের জীবিত কুণ্ড নামে বিখ্যাত। সেই রাতেই জয় দত্তকে স্বপ্নে দেখা দেন দেবী। ওই দিন ছিল শুক্লা চতুর্দশী। স্বপ্নাদেশ পেয়ে তারা মায়ের পুজো শুরু করেন ওই বণিক। সেই থেকে তারাপীঠে শুক্লা চতুর্দশীর দিন আবির্ভাব দিবস পালন হয়ে আসছে। এক বার ভয়ঙ্কর প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় মন্দির। মল্লারপুরের জমিদার জগন্নাথ রায় নতুন করে মন্দির তৈরি করেন। বর্তমান তারা মায়ের মন্দির প্রায় দুশো পঁচিশ–ত্রিশ বছরের পুরনো।
তারাপীঠ প্রসঙ্গে বামদেবের কথা না বললেই নয়। তারাপীঠের কাছে আটলা গ্রামে বামাচরণ নামে এক শিশুর জন্ম হয়। সন্তানের জন্মের কিছুদিন পরই তার বাবা মারা যান। মাও গরীব, তাই সন্তান লালন–পালনের সমস্যা এসেছিল। তাকে তার কাকার কাছে পাঠানো হয়। মামা থাকতেন তারাপীঠের কাছে এক গ্রামে। যেমনটি সাধারণত অনাথদের ক্ষেত্রে হয়। গ্রামের শ্মশানে আসা সাধুবাবাদের সাহচর্যে থাকতে থাকতে বামাচরণেও দেবীর প্রতি ঝোঁক বাড়তে থাকে। এখন সে তারা মাকে বড় মা বলে ডাকে।
কখনো বামা চরণ শ্মশানে জ্বলন্ত চিতার কাছে বসে থাকতেন, কখনো বাতাসে কথা বলতেন। এভাবেই তিনি বয়ঃসন্ধিতে পৌঁছেছেন। তার বিরোধীতার কারণে, তার নাম বামাচরণ থেকে বামাক্ষ্যাপা হয়। খেপা মানে পাগল। অর্থাৎ গ্রামবাসীরা তাকে অর্ধ পাগল মনে করত। নিজের নামের সাথে ‘পাগল‘ ডাকনাম জুড়ে দিয়েছিলেন। সেটি ছিল ভাদ্রপদ মাসের শুক্লপক্ষের তৃতীয়া তিথি, মঙ্গলবার। ভগবতী তারার সিদ্ধির জন্য চূড়ান্ত সিদ্ধ মুহুর্ত। তখন রাতের সময় বামাখেপা জ্বলন্ত চিতার পাশে শ্মশানে বসে ছিল, যখন নীল আকাশ থেকে আলো ফুটে চারদিকে আলো ছড়িয়ে পড়ে। একই আলোকে বামাচরণ মা তারার দর্শন পেয়েছিলেন। কোমরে বাঘের চামড়া পরা। এক হাতে অস্ত্র। এক হাতে মাথার খুলি, এক হাতে নীল পদ্ম ফুল, এক হাতে খড়গ। মা তারা মাথায় হাত রাখাতে বামাক্ষ্যাপা সেখানে সমাহিত হয়। সমাধি অবস্থায় তিনি ৩ দিন ও ৩ রাত শ্মশানে অবস্থান করেন। ৩ দিন পর জ্ঞান ফেরে এবং জ্ঞান ফেরার সাথে সাথে বামা চিৎকার করে এদিক ওদিক দৌড়াতে থাকে। গ্রামবাসীরা নিশ্চিত হয় যে বামা সম্পূর্ণ পাগল হয়ে গেছে। বামার এই অবস্থা একমাস ধরে চলল। কিছু দিন পর, ভগবতী তারা সেখানকার রাণীর কাছে স্বপ্নে আবির্ভূত হন এবং তাকে নির্দেশ দেন যে শ্মশানের কাছে আমার জন্য একটি মন্দির তৈরি করুন এবং বামাকে পুরোহিত কর। পরদিন থেকে মন্দিরের নির্মাণ কাজ শুরু হয়। কিছু দিনের মধ্যেই মন্দিরের কাজ শেষ হয় এবং বামাকে মন্দিরের পুরোহিত করা হয়। বামা খুব খুশি হয়েছিলেন কারণ তার বড় মা তার সাথে আছে তাই। অনেক পান্ডা অর্ধ পাগলকে এমন মন্দিরে পুরোহিত বানাতে পছন্দ করেননি। তারা বামাক্ষ্যাপাকে তাড়াবার পথ খুঁজতে থাকে। বামাক্ষ্যাপার কাজগুলো ছিল অদ্ভুত। কখনো কখনো সারাদিন পূজা করতেন। কখনও কখনও তিনি দু তিন দিন পূজা করেন না। কখনো দেবীকে মালা পরাতেন আবার কখনো নিজে পরতেন। এই প্রক্রিয়াগুলির কোনটিই পুরোহিতদের মতে শাস্ত্রীয় পূজা পদ্ধতির সাথে মিলত না। তারপর একদিন এমন হল যে, যখন প্রসাদ তৈরি হল এবং মন্দিরে পৌঁছানোর পরে, দেবীকে ভোগ নিবেদনের আগে, বামাক্ষ্যাপার মনে চিন্তা এলো যে এটির স্বাদ নেওয়ার এবং এটি মায়ের খাবারের যোগ্য কি না। এরপর আর কোনো চিন্তা ছিল না। প্রসাদের থালায় হাত ঢুকিয়ে মুখে দিলেন স্বাদ নিতে। চেখে দেখার পর যখন ঠিক মনে হল, তখন বাকি প্রসাদটা মাকে দিলেন। এত বড় সুযোগ পণ্ডিতরা কেনো হাতছাড়া করবেন? বামা দেবীর প্রসাদ খেয়েছেন বলে তারা তোলপাড় সৃষ্টি করে। এখন দেবী রাগান্বিত হবেন, সারা গ্রামকে তার ক্রোধ বহন করতে হবে। এই শুনে গ্রামবাসীরা বামাচরণকে কঠোরভাবে মারধর করে। তাকে শ্মশানে নিয়ে গিয়ে ফেলে দেওয়া হয়। মন্দিরটি পুরোহিতদের দখলে যায়। তিনি শুদ্ধিকরণ এবং সমস্ত প্রক্রিয়া করেছিলেন। ওই দিন পুরোহিতদের কথামতো পুজো হয়।
ওদিকে যখন জ্ঞান ফিরল, তখন বামাক্ষ্যাপা মায়ের উপর রেগে গেল, আমি কি দোষ করেছি যে আপনি আমাকে মারধর করলেন। আপনাকে দেওয়ার আগে খাবারটি সুস্বাদু কি না তা পরীক্ষা করছিলাম। এতে আমার কি ভুল ছিল? আমি আপনাকে সুস্বাদু খাবার দেওয়ার চেষ্টা করছিলাম এবং চেয়েছিলাম আপনি ভাল স্বাদের প্রসাদ পান। স্বাদ খারাপ হলে ফেলে দিতাম আর একটা বানিয়ে ফেলতাম, কিন্তু তুমি অকারণে আমাকে মারধর করেছ, আমি এখন আর তোমার কাছে আসব না। তার অবস্থা ছিল ঠিক যেমন শিশুরা তাদের মায়ের উপর রাগ করে কোন কোণে লুকিয়ে থাকে তেমন। বামাচরণ ও তারা মায়ের সম্পর্ক ছিল মা–ছেলের মতো। তারা মা তার সন্তানের যন্ত্রণা সইতে পারেননি। সেই রাতেই রানীর স্বপ্নে দেখা দিল মা। রাগান্বিত মা রাণীকে ভর্ৎসনা করলো–তোমার পুরোহিতরা আমার ছেলেকে আঘাত করেছে। আমি তোমার মন্দির ছেড়ে চলে যাচ্ছি। এখন তোমাকে ও তোমার রাজ্যকে আমার ক্রোধ সইতে হবে, তুমি যদি তা এড়াতে চাও, কাল আমার ছেলেকে ফিরিয়ে এনে মন্দিরে পূজার দায়িত্ব দাও, নইলে পরিণতি ভোগ করতে প্রস্তুত থাকো। রাণী আতঙ্কে বিছানায় উঠে পড়ল। রাণীর রাত্রি যাপন করাও কঠিন হয়ে পড়ল। সারা রাত জেগে কাটালেন। পরের দিন তিনি মন্দিরে ছুটে গেলেন। সম্পূর্ণ তথ্য পাওয়ার সাথে সাথে রানী তার লোক নিয়ে মন্দিরে পৌঁছে যান। তিনি সমস্ত পান্ডাকে তিরস্কার করলেন এবং তাদের মন্দিরে প্রবেশ নিষিদ্ধ করলেন। তিনি তার ভৃত্যদের আদেশ দিলেন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বামাখেপাকে নিয়ে আসতে। তারা বামাক্ষ্যাপাকে খুঁজতে লাগলো সর্বত্র। এক ভৃত্য বামাক্ষ্যাপাকে গুহায় বসে থাকতে দেখে, কিন্ত তিনি ফিরতে রাজি না হওয়ায়, ভৃত্য গিয়ে বিষয়টি রাণীকে জানালেন। অবশেষে রানী নিজেই পৌঁছে গেলেন গুহায়। বামা তার উপরও রাগ প্রকাশ করল। কিন্তু তার শিশুসুলভ স্বাচ্ছন্দ্য দেখে রানীর মনও ভালোবাসায় ভরে গেল। তিনি আদেশ জারি করেন, এই মন্দিরের পুরোহিত বামাক্ষ্যাপা। সে স্বাধীন। তার পথে কেউ আসলে তাকে শাস্তি দেওয়া হবে। এই ভাবে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তারাপীঠে নানা লীলার স্বাক্ষী থেকেছেন তারাপীঠের জীবন্ত শিব বামদেব। মন্দিরের গর্ভগৃহে তারা মা উত্তরমুখী। ‘তারা মায়ের গর্ভগৃহে প্রবেশের জন্য উত্তরের প্রধান দ্বারটিই প্রধানত ব্যবহৃত হয়। বেদির ওপর আছে তারা মায়ের ব্রহ্মশিলা, যা সবসময় দৃষ্টিগোচর হয় না। প্রতিদিন বিশেষ–বিশেষ সময়ে এই ব্রহ্মশিলা দর্শন করা যায়। ভারতবর্ষে সম্ভবত এমন কোনো মন্দির নেই যেখানে এরকম একটি ধর্মীয় প্রথা রয়েছে। আর এই ব্রহ্মশিলা দর্শন করার ব্যাপারে ভক্তদের আগ্রহও অপরিসীম। অনেক ভক্তই মনে করেন ব্রহ্মশিলা দর্শন করতে না পারলে তারাপীঠ তীর্থ ভ্রমণ পরিপূর্ণতা লাভ করে না। তারা মায়ের লোলজিহ্বা। মুখোশের আড়ালে শিলামূর্তি শাড়িকাপড়ে জড়ানো থাকে। মায়ের সব সময় রাজবেশ। আলুলায়িত কেশরাশি। সিঁথিতে চওড়া সিঁদুর। সেই সিঁদুরের কিছুটা অংশ এসে পড়েছে তৃতীয় নয়নে। মাথায় সুউচ্চ কারুকার্যময় রুপোর মুকুট। মায়ের পুষ্পসাজও দেখার মতো। নাকে সোনার নোলক। ওষ্ঠের (ঠোঁট) চারপাশে রক্তেমাখা। মায়ের কণ্ঠে রুপোর মুণ্ডমালা। সঙ্গে অন্য অলংকার তো আছেই। তারা মায়ের গর্ভগৃহ খুব একটা বড়ো নয় বলে একসঙ্গে বেশি লোক ধরে না। ভিড়ের মধ্যেই দু–তিন মিনিটের মধ্যে পূজা শেষ করতে হয়। তারই মধ্যে পাণ্ডার মন্ত্রোচ্চারণ, ভক্তের পুষ্পাঞ্জলি সারতে হয়। সিঁদুররঞ্জিত বেদিতে মাথা ঠেকিয়ে মাকে প্রণাম করার পর তারা মাকে স্পর্শও করা যায়। এব্যাপারে কোনো বাধানিষেধ নেই। মায়ের ঠিক সামনে কম উচ্চতায় একটি ছোটো বেদির ওপর মায়ের ধাতুর তৈরি পাদপদ্ম রাখা আছে। প্রচণ্ড ভিড়ের সময় গর্ভগৃহে প্রবেশ যখন পুরোপুরি বন্ধ করে দেওয়া হয়, তখন এই পাদপদ্ম দর্শনেই সন্তুষ্ট হন ভক্তরা। এই মন্দিরে আলাদা করে পূজা দিতে হলে ‘তারা মাতা সেবাইত সংঘ‘-এর সঙ্গে যোগাযোগ করতে হয়।
সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে তারাপীঠে তীর্থযাত্রীর ভিড় ক্রমশ বাড়ছে। মাকে শীতলভোগ দেওয়ার পরই গরমকালে সকাল ৬–৩০মি. ও শীতকালে সকাল ৭টায় দর্শনার্থীদের জন্য গর্ভগৃহের দ্বার খোলা হয়। তারপর ভক্তদের জন্য পূজা চলে গরমকালে বেলা ১২–৩০মি. পর্যন্ত ও শীতকালে বেলা ১টা পর্যন্ত। গরমকালে দুপুর ১২.৩০ থেকে ১.৩০ ও শীতকালে ১২.৪৫ থেকে দুপুর দু‘টোর মধ্যে মায়ের মধ্যাহ্নভোগ ও বিশ্রামের সময় নির্ধারিত আছে। মায়ের মধ্যাহ্নভোগে থাকে আতপান্ন (আতপ চালের ভাত), মাছ অথবা মাংস। সঙ্গে থাকে নানা রকমের শাক–সবজি, পোলাও, বেগুনভাজা, আলুভাজা, পটলভাজা, চাটনি, দই ও মিষ্টি। মুসুর ডাল চলে না। মাছের মধ্যে রুই, কাতলা অথবা শোলমাছ। বোয়াল মাছ দেওয়া হয় না। বাইরের কেনা মাংস নয়, তারা মন্দিরের আঙিনায় ছাগ বলির রান্না করা মাংসই মায়ের পছন্দ।
সরকারি অনুমোদন নিয়ে (নম্বর (/IL১২৫২৯৮) ১৯৭৪ সালে ‘তারা মাতা সেবাইত সংঘ‘ স্থাপিত হয়। স্বর্গীয় শিবশঙ্কর মুখোপাধ্যায় দ্বারা প্রতিষ্ঠিত এই সংঘ বর্তমানে মায়ের সেবা–পূজা ও মন্দির সংক্রান্ত যাবতীয় কাজকর্ম দেখাশোনা করে থাকে। সংঘের কার্যকরী সমিতির বর্তমান সদস্য সংখ্যা ১১ জন। প্রতিদিন আর একটি ভোগ ‘তারামাতা সেবাইত সংঘ‘ থেকে মাকে নিবেদন করা হয়। এটি পুরোপুরি নিরামিষ। সেবাইত সংঘের নিরামিষ ভোগ পূজার পর ভক্তরা একটা নির্দিষ্ট অর্থের বিনিময়ে কুপন কেটে ভোগমণ্ডপের বারান্দায় বসে খেতে পারেন। তারা মাকে মধ্যাহ্নভোগ নিবেদনের আগে বামদেব অর্থাৎ শ্রীশ্রী বামাখ্যাপার ভোগ হয়। মায়ের মন্দিরের আঙিনায় বামদেবের যে মন্দিরটি আছে, সেখানেই আমিষ ও নিরামিষ ভোগ দেওয়ার রীতি আছে।
মধ্যাহ্নে মায়ের বিশ্রামের সময় এক ঘণ্টা থেকে সোয়া এক ঘণ্টা। এর পর গর্ভগৃহের দ্বার খুলে দেওয়া হয়। গ্রীষ্মে দুপুর ১.৩০মি. থেকে সন্ধ্যা ৬টা ও শীতে দুপুর ২টো থেকে বিকেল ৫.৩০ পর্যন্ত তারা মায়ের সেবা–পূজায় অংশগ্রহণ করতে পারে সর্বসাধারণ। গরমকালে মায়ের সন্ধ্যারতি ৬টা থেকে ৭.৩০ মি. ও শীতের সময় ৫.৩০ মি. থেকে ৭ টার মধ্যে শেষ হয়। এরপর মায়ের শীতল ভোগ। গরমকালে সন্ধ্যা ৭.৩০ মি. থেকে রাত ৮.৩০মি. শীতের সময় সন্ধ্যা ৭টা থেকে ৮টা পর্যন্ত পুনরায় মায়ের সেবাপূজা হয়। গরমকালে রাত ৮.৪৫মি. থেকে ১১টা ও শীতে রাত ৮.১৫মি. থেকে ১১টা পর্যন্ত মায়ের আদিরূপ দর্শন হয়। এর পর মায়ের শয়নের ব্যবস্থা, তার পর মন্দির বন্ধ হয়। ভোরেও মায়ের আদিরূপ দর্শন করা যায়।
তারাপীঠ প্রসঙ্গে কৌশিকী অমাবস্যার কথা না বললে তা অসম্পূর্ণ থেকে যায়। কৌশিকী অমাবস্যা, অন্য সব অমাবস্যার থেকে একটু আলাদা, কারণ তন্ত্র মতে ও শাস্ত্র মতে ভাদ্র মাসের এই তিথিটি একটু বিশেষ। অনেক কঠিন ও গুপ্ত সাধনা এই দিনে করলে আশাতীত ফল মেলে। সাধক কুলকুণ্ডলিনী চক্রকে জয় করে। বৌদ্ধ ও হিন্দু তন্ত্রে এই দিনের এক বিশেষ মাহাত্ম্য আছে। তন্ত্র মতে এই রাতকে ‘তারা রাত্রি‘ও বলা হয়। এক বিশেষ মুহূর্তে স্বর্গ ও নরক দুইয়ের দরজা মুহূর্তের জন্য খোলে ও সাধক নিজের ইচ্ছা মতো ধনাত্মক অথবা ঋণাত্মক শক্তি সাধনার মধ্যে আত্মস্থ করেন ও সিদ্ধি লাভ করেন।
আমাদের এই শক্তি পীঠ যাত্রায় বিভিন্ন্ জেলার ৬০ জন মাতৃ ভক্ত একটি ভ্রাম্যমাণ বাসকে রথের ন্যায় সজ্জিত করে পশ্চিমবঙ্গের প্রত্যেকটি শক্তি পীঠ পরিক্রমা করে সেখান থেকে পবিত্র জল, মাটি, প্রসাদ, পুস্প সংগ্রহ করে বাংলার কুম্ভ ত্রিবেণীতে পৌঁছে মা গঙ্গা , যমুনা ও সরস্বতী নদীর সঙ্গমে সাধু–সন্ত দের করকমলের দ্বারা অর্পণের মাধ্যমে বঙ্গীয় কুম্ভ মেলা কে ঈশ্বরীয় আধ্যাত্ম পুষ্পে শোভিত করে। ৫ ফেব্রুয়ারী থাকে ১০ ফেব্রুয়ারী পর্যন্ত এই শক্তি পীঠ পরিক্রমা চলে জলপাইগুড়ি ভ্রামারী দেবী থেকে শুরু হয়ে অবশেষে কলকাতার কালীঘাটের মায়ের আশীর্বাদ নিয়ে মাতৃ রথ বঙ্গীয় ত্রিবেণী কুম্ভে ১০ প্রবেশ করে ফেব্রুয়ারী সন্ধ্যায় । ১১ ফেব্রুয়ারি থেকে ১৩ ফেব্রুয়ারি চললো বঙ্গীয় ত্রিবেণী কুম্ভ , মূলত ২০২২ থেকে ত্রিবেণী কুম্ভ পরিচালনা সমিতির পৃষ্ঠপোষকতা এবং তত্ত্বাবধানে ত্রিবেণী কুম্ভের অংশ হিসেবেই এই শক্তি পীঠ পরিক্রমা চালু করা হয় । এবারের বঙ্গীয় কুম্ভে এই চৌদ্দ শক্তিপীঠের জল , মাটি নাগা সাধুদের হাতে তর্পনের সাথে সাথে , প্রতিষ্ঠিত হয় ত্রিবেণী বাঁশবেড়িয়ার প্রসিদ্ধ কালী মন্দির ডাকাত কালীবাড়িতে , ১৪ সতীপীঠের পবিত্র জল মাটি মাতৃলয়ে মায়ের সাথেই পূজিত হবে সারা বছর ধরে , হবে হোম যজ্ঞ বিশেষ অনুষ্ঠান , ত্রিবেণী কুম্ভ পরিচালনা সমিতির প্রধান পৃষ্ঠপোষক মাননীয় কাঞ্চন ব্যানার্জি ও মহাশয় শ্রীকান্ত মুখার্জি মহাশয় শক্তিপীঠ পরিক্রমা যাত্রার মূল কান্ডারী। এই পরিক্রমা ঐহিক আনন্দ ও ত্যাগের প্রতীক । হিন্দুত্বের এই পুনঃজাগরণ মাতৃ আরাধনা ও ভারত মাতাকে ফের পরম বৈভাবশালী করার জন্য। হিন্দুত্বের এই পুনঃজাগরণ ভারত মাতাকে ফের পরম বৈভাবশালী করার জন্য । বঙ্কিমচন্দ্রের ‘আনন্দমঠ‘ উপন্যাসে ভবানন্দকে বলতে শোনা গিয়েছিল, ‘আমরা অন্য মা মানি না, জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরীয়সী।‘ এই সনাতন হিন্দুধর্মই পেরেছে দেশকে শুধু একটি জড় পদার্থ নয়, বরং মা হিসাবে দেখতে। তাই দেশ মায়ের এই ভক্তদের হাত ধরেই বিশ্বের মাঝে ধ্বনিত হবে ভারত মাতার জয়গান।
বাংলাদেশের ইতিহাস – রমেশচন্দ্র মজুমদার
পল্লব মণ্ডল