Monday, October 6, 2025
HomeArticlesResearch & Scholarlyপরমবৈষ্ণব শ্যামানন্দ মণ্ডল parama vaishnava shyamananda mandal

পরমবৈষ্ণব শ্যামানন্দ মণ্ডল parama vaishnava shyamananda mandal

বাংলাদেশে মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্যদেবের আবির্ভাব এবং পঞ্চদশ ও ষোড়শ শতাব্দীতে ভক্তি আন্দোলন একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। খৃস্টীয় ষোড়শ শতাব্দীতে চৈতন্যদেব যখন মেদিনীপুর ও খড়গপুর হয়ে জগন্নাথধাম পুরীতে যান তখন এসব অঞ্চলের অসংখ্য মানুষ বৈষ্ণবধর্ম গ্রহণ করেন। চৈতন্যদেবের এই ভক্তি আন্দোলনের ঢেউয়ে আন্দোলিত হয়েছিল সমগ্র মেদিনীপুর ও ওড়িশা অঞ্চল। পরবর্তীকালে বৈষ্ণবদের মধ্যে গোষ্ঠীবিরোধ দেখা দিলে সেই বিরোধ থেকে পরিত্রাণ পেতে সক্রিয় ভূমিকা নেন এখানকার পরম বৈষ্ণব শ্রীশ্রী শ্যামানন্দ। আর মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্যদেবের পর যে তিনজন বৈষ্ণব প্রভুর আবির্ভাব হয় শ্রীশ্রী শ্যামানন্দ (parama vaishnava shyamananda mandal) তাঁদের একজন। অন্যেরা হলেন শ্রীনিবাস ও নরোত্তম ঠাকুর। শ্রীনিবাস মধ্যবঙ্গে ও মধ্য রাঢ়ে এবং শ্যামানন্দ দক্ষিণ রাঢ়ে ভক্তি আন্দোলনের পুরোধা ছিলেন। পরম বৈষ্ণব শ্রীশ্রী শ্যামানন্দ মণ্ডলের জন্ম চৈত্র ১৪৫৭ শকাব্দ বা চৈত্র ৯৪১বঙ্গাব্দ বা ১৫৩৫ খৃষ্টাব্দ।

parama vaishnava shyamananda mandal
parama vaishnava shyamananda mandal

“নিত্যানন্দ প্রভুর প্রিয় শাখা গৌরী দাস ।

যাঁহার আজ্ঞায় কৈলা অম্বিকায় বাস ৷৷

তাঁর শিষ্য হৃদয় চৈতন্য মহাশয় ৷

শ্রীসুধীরা সখী তাঁর সিদ্ধ নাম হয় ৷৷

তাঁর শিষ্য সদ্গোপ জাতি দুঃখী কৃষ্ণদাস ।

শ্যামানন্দ নাম বৃন্দাবনেতে প্ৰকাশ ৷৷

 

শ্যামানন্দের সিদ্ধ নাম কণক-মঞ্জরী।

তত্ত্ব শিখাইলা জীব তাঁরে কৃপা করি ॥”

 

শ্যামানন্দ অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলার ধারেন্দা গ্রামে ১৫৩৫ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। গ্রামটি খড়গপুরের কলাইকুণ্ডার কাছে অবস্থিত। তবে অনেকের মতে তাঁর জন্মস্থান ছিল দণ্ডেশ্বর নামে গ্রামে। কিন্তু আজও ধারেন্দাতে শ্যামানন্দের আবির্ভাবতিথি পালিত হয় এবং নিত্যসেবা হয়।

 

“দণ্ডেশ্বর গ্রামে বাস সৰ্ব্বাংশে প্রবল।

মাতা শ্রীদুরিকা পিতা শ্রীকৃষ্ণ মণ্ডল।।

ধারেন্দা-বাহাদুরর-পুরেতে পূৰ্ব্বস্থিতি।

শিষ্টলোক কহে শ্যামানন্দ-জন্মতিথি।।

কোন মতে মণ্ডলের নাহি প্রতিবন্ধ।

পুত্ৰ-কন্যা গত হৈলে হৈলে শ্যামনন্দ৷৷

জন্মিলেন শ্যামানন্দ অতি শুভক্ষণে।

যে দেখে বারেক তার মহানন্দ মনে৷৷”

 

পিতার নাম ছিল শ্রীকৃষ্ণ মণ্ডল ও মাতার নাম ছিল দুরিকাদেবী। জাতিতে সদগোপ শ্রীকৃষ্ণ মণ্ডল ছিলেন খুবই কৃষ্ণভক্ত। শ্যামানন্দের বাল্যকালের নাম ছিল দুখিয়া। ছেলেবেলা থেকেই তাঁর ছিল কৃষ্ণপদে মন। বৈষ্ণবকথা ও কীর্তন শুনলেই তাঁর চোখ বেয়ে নেমে আসত প্রেমাশ্রু। খুব কম সময়ের মধ্যে তিনি ব্যাকরণ শাস্ত্রাদি পাঠ শেষ করেন এবং বৈষ্ণবসঙ্গ লাভ করেন। মনে নেমে আসে বৈরাগ্য ভাব। এরপর তিনি দীক্ষা নেন হৃদয়চৈতন্য প্রভুর কাছে। হৃদয়চৈতন্য ছিলেন গৌর নিত্যানন্দের প্রিয় পার্ষদ শ্রী শ্রী গৌরদাস পণ্ডিতের প্রিয় শিস্য। দীক্ষার পর দুখীর নাম হল কৃষ্ণদাস। এরপর বৃন্দাবনে শ্রীজীব গোস্বামীর কাছে দীক্ষা নেবার পর তাঁর নাম হয় শ্যামানন্দ। বৃন্দাবনে এলে তিনি শ্রীনিবাস আচার্য এবং নরোত্তম ঠাকুরের পাদপ্রদীপের আলোয় আসেন। পাঠ করেন ভক্তিশাস্ত্র গ্রন্থ। শ্রীজীব গোস্বামীর আদেশে এবার শ্যামানন্দ মেদিনীপুর অঞ্চলে ধর্মপ্রচারে মন দেন। এ প্রসঙ্গে একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করতেই হয়। শ্রীজীব গোস্বামী গৌড়ে বৃন্দাবন থেকে অনেক বৈষ্ণবগ্রন্থ পাঠাচ্ছিলেন। এ কাজে নিযুক্ত ছিলেন শ্রীনিবাস আচার্য, নরোত্তম ঠাকুর, শ্যামানন্দ।

 

শ্যামানন্দ মন্ডলের জীবনী থেকে তৎকালীন সদগোপ সমাজের উপননয়নের তথ্যোও পাওয়া যায়। ১৬ শ শতকে সদগোপদের উপনয়ন হত আজো বেশ কিছু কুলীন সদগোপ পরিবারের উপনয়ন প্রথা রয়েছে।

 

“একদিন শ্যামানন্দ আছেন নির্জ্জনে।

দামোদর গিয়া কৈল দণ্ড পরণামে ৷

শ্যামানন্দের রূপ দেখে পরম উজ্জ্বল ।

জ্যোতিৰ্ম্ময় পৈতা অঙ্গে করে ঝলমল ৷৷

হেনকালে আইলা রসিকাদি ভক্ত সব।

দণ্ডবৎ প্রণাম করি কৈলা বহু স্তব ৷৷

শ্যামানন্দ যজ্ঞোপবীত করিয়া গোপন ।

তেজ ঢাকি আরম্ভিলা নাম সংকীৰ্ত্তন ॥”

 

অথবা

 

“হৃদয় চিরিয়া শ্যামানন্দ পৈতা দেখাইলা ।”

 

কিন্তু মল্লভূম (আজকের বিষ্ণুপুর) পার হবার সময় সেসব গ্রন্থ সোনাদানা ভেবে লুঠ করে নিয়ে যায় রাজা বীরহাম্বিরেরে সৈন্যরা। সেই ঘটনায় সবাই বিহ্বল হয়ে পড়েন ও কাঁদতে থাকেন। শ্রীনিবাসের পরামর্শে শ্যামানন্দ ফিরে যান বৃন্দাবনে। পরে সেসব বৈষ্ণবগ্রন্থ উদ্ধার হয় এবং রাজা বীরহাম্বির বৈষ্ণবধর্ম গ্রহণ করেন। সে আরেক কাহিনী। যাইহোক শামানন্দকে শ্রীজীব গোস্বামী এবার উৎকল তথা আজকের মেদিনীপুর অঞ্চলে পাঠান বৈষ্ণবধর্ম প্রচার করতে। শ্যামানন্দ সেই হরিনাম বিলানোর কাজ এতো পরিশ্রম সহকারে করেছিলেন যে হাজার হাজার মানুষ সামিল হয়ে গেলেন এই বৈষ্ণব আন্দোলনে। অসংখ্য মানুষ দীক্ষিত হলেন বৈষ্ণবধর্মে। এলাকার অসংখ্য জমিদার যাদের কাজ ছিল দরিদ্র শোষণ, অত্যাচার তারাও সামিল হলেন এই আন্দোলনে। শোষক শোষিতের ভেদাভেদ মুছে যেতে লাগল। এক সাম্যঅবস্থা দেখা দিল সমাজে। শ্যামানন্দের অক্লান্ত পরিশ্রমেই তা সম্ভব হয়েছিল। শ্যামানন্দের প্রধান শিষ্য হলেন রসিকানন্দ। সুবর্ণরেখা নদীর অদূরে রোহিণী গ্রামে রসিকানন্দের জন্ম হয় ১৫৯০ খ্রিস্টাব্দে এক রাজ পরিবারে। ছেলেবেলা থেকেই ছিলেন ভাগবত অনুরাগী। দীক্ষিত হন শ্যামানন্দের কাছে। শ্যামানন্দ পেলেন এক আদর্শ ও ভক্তিপ্রাণ সহযোগী।

 

গুরুদেব শ্যামানন্দের সাথে তিনি বলরামপুর, বগড়ী, বসন্তপুর, চাকুলিয়া, ঘাটশিলা, বালেশ্বর প্রভৃতি তিনি বৈষ্ণবধর্ম প্রচারে মেতে ওঠেন। শ্যামানন্দের বৈষ্ণব আন্দোলনে অস্থির সমাজে ফিরে আসে সুস্থির ও শান্তির পরিবেশ। রাজা- প্রজা-জমিদার নির্বিশেষে সবাই মেতে ওঠেন ভাগবত প্রেমে। তাছাড়া বৈষ্ণবধর্ম গ্রহণের ফলে জনজাতী সম্প্রদায়েরও অসংখ্য মানুষ আপ্লুত হন ভাগবতপ্রেমে। শ্যামানন্দ ও তাঁর শিষ্যরা যে বিভিন্ন অঞ্চলে বৈষ্ণবধর্ম প্রচার করেছিলেন তাঁর বিবরণ রয়েছে নরহরি চক্রবর্তী রচিত ভক্তি-রত্নাকর গ্রন্থে। রয়েছে গোপীজনবল্লভ দাস রচিত শ্রীশ্রী রসিকমঙ্গল গ্রন্থে । এই রসিকমঙ্গলকাব্যটি ভঞ্জভূম রাজ সভায় লেখা হয় মূল পুথিটিও ওড়িশায় রয়েছে । কিন্তু বর্তমান ওড়িয়া প্রশাসন এটি মঙ্গলকাব্য বুঝতে পেরে এটির উপর সংস্কৃত পান্ডুলিপির ছাপ লাগিয়ে দিয়েছেন।

 

এ বিষয়ে উল্লখ করা যেতে পারে যে গোপীজনবল্লভের পিতা রসময় দাস শ্যামানন্দের কাছে দীক্ষা গ্রহণ করেন।

 

“গোপকুলশশী উৎকলে প্ৰকাশিয়া ।

পাপ-তিমির নাশিলা প্রেম ভক্তি দিয়া ॥”

 

শ্যামানন্দের (parama vaishnava shyamananda mandal) অন্যান্য শিষ্যের মধ্যে দামোদর যোগী ও পাঠানশাসক শের খাঁর নামও উল্লেখযোগ্য। জাতধর্ম নির্বিশেষে মানুষ বৈষ্ণবধর্মে আকৃষ্ট হবার ফলে এক আশ্চর্য সাধনক্ষেত্রে পরিণত হয়েছিল এখানকার বিস্তৃত অঞ্চল। একলীন হয়ে গেল ব্রাহ্মণ-চণ্ডাল  সবাই। অন্যতম শিষ্য রসিকানন্দ পরে সুবর্ণরেখার অপর তীর গোপীবল্লভপুরে গোপীবল্লভজীউয়ের বিগ্রহ স্থাপন করেন। দীর্ঘ প্রায় সাড়ে তিনশ বছরের উপর রসিকানন্দের বংশধরেরা এখনো বৈষ্ণব ধর্ম প্রচার করে চলেছেন।

শ্রীমৎ শ্যামানন্দ চরিত

Raja Bikramjit Ghosh The Sadgop Ruler Who Resisted the Delhi Sultanate

পল্লব মণ্ডল

RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Most Popular

Recent Comments