বিদ্যাসাগর সম্পর্কে কিছু কিছু মুখরোচক সমালোচনা শুনতে পাওয়া যায় তিনি নাকি কোট, প্যান্ট পরে সাহেবি হোটেলে চপ-কাটলেট খেতে যান। তিনি তখন জোর কদমে তাঁর সমাজ সংস্কার করছিলেন। তিনি নাকি তাঁর বাড়ীতে অল্প বয়সী বিধবাদের পালন করেন। হ্যাঁ, তিনি ব্রিটিশদের অনেক কিছুরই অনুরাগী ছিলেন। ১৮৯১ খ্রীষ্টাব্দের ২৮শে সেপ্টেম্বর ‘ইন্ডিয়ান নেশন’ পত্রিকায় এ সম্পর্কে লেখা হয়েছিল, “তিনি ইংরেজী বই কিনতে প্রচুর অর্থ ব্যয় করেছিলেন। তিনি ইংল্যান্ডের ইংলিশ ফার্মকে দিয়ে তাঁর বই বাঁধিয়েছিলেন, কলকাতায় দফতরিদের দিয়ে নয়। তিনি তাঁর মা ও বাবার ছবি ইংরেজ চিত্রকরদের দিয়ে আঁকিয়েছিলেন, তাঁদের স্মৃতি ধরে রেখেছিলেন। তিনি তাঁর বন্ধু পরলোকগত অধ্যাপক হোরেস হেম্যান উইলসন এবং জীবিত বন্ধু ড: মৌয়াট-এর ছবিও ইংরেজ চিত্রকরদের দিয়ে আঁকিয়ে তাঁদের স্মৃতি রক্ষা করেছিলেন। তাঁর বাড়ির সিঁড়ির পথে তিনি একটা বিলেতি ঘড়ি টাঙিয়ে রাখতেন এবং তাঁর পড়ার ঘরে বিলেতি জল-রঙে আঁকা চিত্র দিয়ে সাজিয়ে রাখতেন। তাঁর ঘরের আসবাব ছিল বিলেতি। বাগান করার তাঁর যে রুচি তাতেও ইংরেজ ঘরানার ছাপ ছিল।” (বিদ্যাসাগর নাস্তিক ছিলেন না)
বিদ্যাসাগর ব্রিটিশদের ম্লেচ্ছ মনে ক’রে দূরে সরিয়ে রাখেন নি। রামমোহন, বিদ্যাসাগর এঁরা নিজেদের ব্রিটিশদের সমকক্ষ করে তুলেছিলেন বা তাদের ছাড়িয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁদের ঘৃণা করেন নি। কোনো মহৎ মানুষের পক্ষে তা সম্ভব নয়। এখানে মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীর কথা মনে পড়ে। তিনি রামমোহনের ইংরেজী শিক্ষার প্রতি আগ্রহের জন্য ( বলা জরুরী যে রামমোহন প্রথম ব্যক্তি যিনি এদেশে আধুনিক ইউরোপীয় উদার, মানবতাবাদী যুক্তিপরায়ণ গণতান্ত্রিক বোধে উদ্বুদ্ধ বৈজ্ঞানিক চিন্তার আনয়ন করতে সচেষ্ট হয়েছিলেন, শুধুমাত্র ইংরেজী আদবকায়দা নয়) তাঁকে পিগমি বলতে ছাড়েন নি। হয় তিনি বিদ্যাসাগর সম্পর্কে জানতেন না বা মন্তব্য করার যোগ্যই তাঁকে মনে করেন নি। তাতে বিদ্যাসাগরের মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হয় নি। শিক্ষা বিস্তার ও সমাজ সংস্কারে তিনি মোহনদাসের চেয়ে অনেক বেশী কৃতিত্বের অধিকারী। বরং গান্ধী সুটবুট টাই পড়ে সাহেবমেমদের কোমড় জড়িয়ে বিলেতি রেস্টুরেন্টে নাচ করতেন।
একজন মুসলিম অভিযোগ করেছেন বিদ্যাসাগর শুধু হিন্দুদের নিয়েই ভেবেছেন মুসলিম সমাজের কুপ্রথাগুলির বিরুদ্ধে কিছুই করেন নি অর্থাৎ তিনি সাম্প্রদায়িক ছিলেন। বাংলাদেশের বইয়ের স্টলে গেলে বাঙালী মুসলমানদের অধিকাংশের লেখায় হিন্দু নিন্দা দেখতে পাই। কাজেই এই রকম অভিযোগ থেকে এই উপমহাদেশের কোনো মনীষীই রেহাই পাবেন না। তসলিমা নাসরিনের কথা মনে পড়ে? তাঁকে বাংলাদেশ থেকে কুকুরের মত তাড়া করা হয়েছিল। এমন কি বুদ্ধিজীবি পরিকীর্ণ এই বাংলায়ও তাঁর ঠাঁই হয় নি । বেগম রোকেয়ার কথা কেমন আস্তে আস্তে ভুলিয়ে দেওয়া হচ্ছে। তিন তালাক বিল নিয়ে তুলকালাম চলছে কারণ হিন্দু অধ্যুষিত এই দেশে রাজনৈতিক দলগুলি মেরুদন্ডহীন; তারা মুসলিম ভোটব্যাঙ্ক হারাবার ভয়ে তিন তালাক বিলে সমর্থন দিচ্ছে না। যখন এক সম্প্রদায়ের কেউ অন্য সম্প্রদায়ের মঙ্গলবিধানের চেষ্টা করেন তাতে অন্য সম্প্রদায়ের ঘরোয়া ব্যাপারে নাক গলানোর অভিযোগ উঠবেই (বিদ্যাসাগর নাস্তিক ছিলেন না)।
যাঁরা মুসলিম বহুবিবাহের ক্ষেত্রে বিদ্যাসাগরের নিস্পৃহতার অভিযোগ করেন তাঁরা কি দেখতে পান না যেই কেউ এ চেষ্টা করেছেন তাঁর কি হাল হয়েছে? একজন সচেতন ব্যক্তি হিসাবেই তিনি তাঁর সমাজ সংস্কার তাঁর নিজের সমাজের জন্য সীমাবদ্ধ রেখেছিলেন। ২০১৮ সালে ফেসবুকে এক বাংলাদেশী মুসলিম কবি স্ত্রীর সঙ্গে ছবি পোস্ট করলে কমেন্টে একের পর এক অভিযোগ আসে, “ভাইয়া, ভাবী পর্দা করেন নাই কেন?” সেই ১৮৫০ সালে যদি এক হিন্দু ব্রাহ্মণ পন্ডিত মুসলমান সমাজের বহুবিবাহ, তাৎক্ষণিক তিন তালাক ও পর্দা প্রথার বিরুদ্ধে শোরগোল তুলতেন তা হ’লে দাঙ্গার আগুন অনির্বাণ হ’ত। মুসলমানদের জন্য ব্যক্তিগত সহায়তা করা ছাড়া তাঁর আর কিছু করার ছিল না সেটা তিনি করেছেন। অর্থ ও চিকিৎসার সুযোগ করে দিয়েছেন মুসলমান সমাজের লোকজনকে। শুধুমাত্র মোরাদাবাদে ১৯৮০ সালের ১৬ই আগস্ট মসজিদে কেউ একটুকরো শুয়োরের মাংস রাখার কারণে সেখানকার হিন্দু প্রশাসককে মুসলমানরা টুকরো করে কেটেছিল। এ আর রহমান তাঁর সম্প্রদায়কে না চটানোর উদ্দেশ্যে তিন রকমভাবে তাঁর বাড়ীর মহিলাদের ছবি পোস্ট করেছেন। মুসলমানদের সমাজ সংস্কার তাঁদের নিজেদের মধ্যে করতে হবে। অন্য দেশে তা হচ্ছেও। ভারতে কেন হচ্ছে না ভেবে দেখার মত।
আবার দেখুন। সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের কাছে শিক্ষা কাউন্সিলের সচিব জানতে চেয়েছিলেন ব্রাহ্মণ ও বৈদ্য ছাড়া অন্য কোনও জাতের ছাত্রকে ভর্তি নেওয়া যায় কিনা। তার উত্তরে বিদ্যাসাগর জানিয়েছিলেন, “ The reason why I recommend the exclusion of other orders of Shudras at present , is that they as a body, are wanting in respectability and stand lower in the standard of social considerations, there admission, therefore, would I fear, prejudice the interests of the institution.” মনে রাখতে হবে এই চিঠি সিপাহী বিদ্রোহ ঘটার পাঁচ বছর আগে, সতীদাহ রদকারী বিলের মাত্র বাইশ বছর পরে এবং বিধবাবিবাহ বিল পাশ হওয়ার চার বছর আগে। বিদ্যাসাগর হঠকারী বিদ্রোহী ছিলেন না। তিনি ছিলেন ঠান্ডা মাথার একজন সমাজসংস্কারক যার স্থায়ী প্রভাব থাকবে। তিনি এমন বিদ্রোহী ছিলেন না যে বলবেন ‘তাই দেখিয়া শুনিয়া ক্ষেপিয়া গিয়াছি যাহা আসে কই মুখে।‘ তাঁকে প্রতিটি পদক্ষেপ ফেলতে হত মেপে মেপে। এটা তাঁর জাতিভেদ ব্যবস্থার প্রতি শ্রদ্ধা বোঝায় না বোঝায় একজন shrewd মানুষের বিচক্ষণতা, অসময়ে অস্থানে হস্তক্ষেপ করতে গিয়ে মূল কাজটা না অনায়ত্ত থেকে যায়। এই কথাটা অতি বুদ্ধিমানদের বারংবার বুঝিয়েও পারা যায় না। কোনো দীর্ঘকালীন সমস্যা বিশেষত যেখানে লোকাচার দেশাচার এবং ধর্মাচার মিশে যায় , সেখানে তার রদ করা বা যেখানে অর্থনৈতিক সুবিধাভোগের সুযোগ আছেসেখানে সুবিধাভোগীদের তা রাতারাতি ত্যাগ করতে বলা মূর্খামি।
ঈশ্বর সম্পর্কে তাঁর মত তিনি স্পষ্ট করে বলেছেন (বোধোদয় দ্রষ্টব্য): “ঈশ্বর কি চেতন, কি অচেতন , কি উদ্ভিদ সমস্ত পদার্থের সৃষ্টি করিয়াছেন। এ নিমিত্ত , ঈশ্বরকে সৃষ্টিকর্তা বলে । ঈশ্বর নিরাকার চৈতন্য স্বরূপ। তাঁহাকে কেহ দেখিতে পায় না ; কিন্তু তিনি সর্বদা সর্বত্র বিরাজমান আছেন। আমরা যাহা করি , তিনি তাহা দেখিতে পান; আমরা যাহা মনে ভাবি , তিনি তাহা জানিতে পারেন। ঈশ্বর পরম দয়ালু ; তিনি সমস্ত জীবের আহারদাতা ও রক্ষাকর্তা।….. ঈশ্বর কেবল প্রাণীদিগকে চৈতন্য দিয়াছেন। তিনি ভিন্ন আর কাহারও চেতনা দিবার ক্ষমতা নাই।”
ঈশ্বরচন্দ্র বেদান্তকে ভ্রান্ত বলেছিলেন কিন্তু আবার বেদান্ত অধ্যয়নের পরামর্শ দিয়েছিলেন , বেদান্তসার ও ব্যাসের সূত্র । তিনি বিধবা বিবাহের পক্ষে সওয়াল করার সময়ে হিন্দু ন্যায়শাস্ত্রর যুক্তিকেই অবলম্বন করেছিলেন। আসলে যা ঘটেছিল হিন্দু ধর্মদর্শনের মধ্যে প্রচুর প্রক্ষিপ্ত অংশ ছিল আর বিভিন্ন স্থানে অনেক মতবিরোধ থাকার ফলে প্রচুর বিবাদ হ’ত । বিদ্যাসাগর লক্ষ্য করেছিলেন যে এই দেশের পন্ডিতরা সেই অনর্থক বিষয়ে নিয়ে বিবাদ করত। যে উদার মানবতাবাদী ও যুক্তিবাদী মত সেই যুগের চাহিদা ছিল তা পূরণ হচ্ছিল না । পক্ষান্তরে ইউরোপীয় দর্শন অনেক বেশী স্বচ্ছ ও মানবতাবাদী ছিল। কিন্তু আমাদের দেশীয় পন্ডিতরা তা মানতে অস্বীকৃত ছিলেন। তাঁদের আঘাত দেওয়ার দরকার ছিল। বেদান্তের সারমর্ম ও তুলনামূলকভাবে তার সঙ্গে ইউরোপীয় দর্শন পাঠের উপযোগিতার কথা এইসব দেশীয়দের মাথায় প্রবেশ করাতে গেলে একটা জোর ধাক্কা দেওয়ার দরকার ছিল। তিনি তাই করেছিলেন এই কথা ব’লে যে বেদান্ত ও সাংখ্য ভ্রান্ত ।কাজেই একথা বোঝানো গেল যে বেদান্তকে তিনি পত্রপাঠ বিদায় করেন নি। আর সাংখ্য সম্পর্কে তাঁর মতের কারণ এই অধ্যায়ে আগেই ব্যাখ্যা করা হয়েছে । তাঁর মত মানুষ সাংখ্যকে ভুল বলতে পারেন না কারণ সেখানে রয়েছে বস্তুবাদী দর্শনের কথা। আর মানব জাতির ভরকেন্দ্রে যে এক শুভবোধ, কল্যাণ ও মঙ্গল বোধ কাজ করে, যা মূলত: ঈশ্বরের concept তাকে তিনি বিশ্বাস করতেন।

রামমোহন ও বিদ্যাসাগর দুজনেই মনে করতেন ইংরেজদের এদেশে আসাটা খুব জরুরী ছিল । রামমোহন তো বলেইছেন যে তা ছিল ঈশ্বরের আশীর্বাদ। ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের সময়ে ইংরেজ সৈন্যদের শিবির স্থাপনের জন্য সংস্কৃত কলেজকে বাছা হয়েছিল। তখন বিদ্যাসাগর ঐ কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন । তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ তিনি তার প্রতিবাদ করেন নি। তিনি ঠিক কি করেছিলেন তাও খুব স্পষ্ট নয়। কিন্তু মনে রাখতে হবে ব্রিটিশ সরকার ছিল সেই কলেজের মালিক; তাঁদের বাধা দেওয়ার তাঁর কোনো অধিকার ছিল না। ঐ সময়ে কেউই কিন্তু প্রতিবাদ করেন নি। আসলে তখন সিপাহী বিদ্রোহ নিয়ে ভারতের জনগণের মধ্যে তেমন কোনো সাড়া পাওয়া যায় নি। যত কিছু বিশ্লেষণ হয়েছে তার অনেক পরে। তার মধ্যে যোগ দিয়েছে অতি বিপ্লবী কিছু মানুষ। আর কিছু বিভ্রান্ত দেশপ্রেমী। পরাজিত অক্ষম মোগল বাদশাহ তাঁর সাম্রাজ্য পুনরুদ্ধার করতে চেয়েছিলেন। আর কার্তজে গরু ও শুয়োরের চর্বি মেশানো ছিল ব’লে হিন্দু ও মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের সৈন্যরা ক্ষুব্ধ ছিল। সেই সময়ে মঙ্গল পান্ডে নামে এক নিরক্ষর বদমেজাজী, মুখ দিয়ে যার অশ্রাব্য গালিগালাজ বেরত ও সর্বক্ষণ মদ্যপ থাকত একদিন আচমকা গুলি ছুঁড়ে বসে, ব্রিটিশরা ভাবে সেপাইরা বিদ্রোহ করেছে । এবং তারের মাধ্যমে সেই খন্ডিত সংবাদ সত্যই বিদ্যুতের গতিতে ছড়িয়ে পড়ে। সিপাহী বিদ্রোহ সফল হ’লে কি হ’ত। সেই তো বৃদ্ধ বাদশাহের হাতে ক্ষমতা তুলে দেওয়া হ’ত। তাতে আমরা যেটুকু এগিয়েছিলাম তার তিন গুণ পিছিয়ে যেতাম। । ইংরেজ আমলে অনেক কিছু সংশোধন হচ্ছিল ও হওয়ার মত শিক্ষাগত ও সামাজিক পরিবেশ তৈরী হচ্ছিল । সতীদাহরদ , ঠগী দমন, বিধবা বিবাহ, বিবাহের ন্যুনতম বয়স বেঁধে দেওয়া, বহুবিবাহ রদ, বিবিধ আইন সংশোধন,, শিক্ষাসংস্কার, কলেজ ও হাসপাতাল প্রতিষ্ঠাসহ বহু কাজ হয়েছিল । একথা শুধু স্বাজাত্যপ্রেমের ধোঁয়া দিয়ে আড়াল করলে চলবে না। এমন কি ভারতবাসীর মধ্যে যে স্বদেশপ্রেম ও গণতান্ত্রিক চেতনা তা এসেছিল ইংরেজদের হাত ধ’রেই। । তাদের দাক্ষিণ্যে ও পৃষ্ঠপোষকতায় জাতীয় কংগ্রেসের মত গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ( যদিও তা বর্তমানে একটি পরিবারের ব্যক্তিগত সম্পত্তি হয়ে উঠেছে)। ভারতবর্ষ পরাধীন হয়েছিল ১১৯২ সালে মহম্মদ ঘোরীর আগমনের সময়ে থেকে। ইতিহাসে কোনো কিছুই হঠাৎ করে ঘটে না। ১৭৮৯ সালের ফরাসী বিপ্লবের অনেকদিন আগে থেকে শুরু হয়েছিল তার পশ্চাদপট এবং চলেছিল ১৭৮৯ এর পরে অনেকদিন ধ’রে। ইতিহাসে বিপ্লব সেই অর্থে কোনোদিন ঘটে নি ঘটবেও না, যা ঘটে তা ক্রম বিবর্তন ধীরে ধীরে সংঘটিত সংগঠিত পথে , ঠান্ডা মাথায়, কোন কোপনস্বভাব তরলমতির কাজ নয় কোনো বড় পরিবর্তন করা। আর যা ঝড়ের তান্ডবে আসে তা মিলিয়েও যায়। তাকে যদি বিপ্লব বলা হয় আলাদা কথা । বাংলার নবজাগরণ মিথ্যে নয়, বিদ্যাসাগরের সমাজসেবা মানবপ্রেম ঠুনকো ছিল না ।
মায়ের মৃত্যুতে তিনি কাশীপুরে ভাগীরথী তীরে শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠান সম্পাদন করেন; বেশ কয়েকমাস ধরে নির্জন জীবনযাপন করেন ও এইভাবে তিনি এক বছর শাস্ত্রানুসারে শোকপালন করেছিলেন। এইবারো মাস তিনি সত্যিকার হিন্দুদের কঠোর সন্ন্যাস জীবন যাপন করেছিলেন; তিনি মাছও মাংস ছেড়ে দিলেন; দিনে তিনি কেবল একবার খেতেন, নিরামিষাসী, নিজের হাতে রান্না করতেন, স্ত্রী দীনময়ী দেবী ছাড়া আর কারো সাহায্য করার অনুমতি ছিল না তাও তিনি খুব অসুস্থ হলে । তিনি জুতো পরা ছেড়ে দিয়েছিলেন, ছাতা ব্যবহার করতেন না; মেঝের উপর কম্বল পেতে শুতেন। এক ভদ্রলোক বিদ্যাসাগরের ধর্মীয় বিশ্বাস জানতে চেয়েছিলেন। বিদ্যাসাগর জবাব দিলেন, -“আমি কখনো আমার বিশ্বাস কাউকে ঘোষণা করিনি, না আমি কখনোই এটা ঘোষণা করব না; কিন্তু এটাই আমি বলতে পারি যে, যদি আপনি বিশ্বাস করেন যে ভাগীরথীর স্নান আপনাকে বিশুদ্ধ করে এবং শিবের পূজা আপনার হৃদয়কে পবিত্র করে তোলে, সেটাই আপনার ধর্ম”।
এর আগে তাঁর মা তখনও বেঁচে, বেনারসের ব্রাহ্মণরা তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিল যে তিনি বিশ্বেশ্বর (বেনারসের দেবতাশিব) বিশ্বাস করেন কিনা। বিদ্যাসাগর উত্তর দিলেন, – “তোমার বিশ্বেশ্বরে আমার কোন বিশ্বাস নেই। ”ব্রাহ্মণরা হিন্দুর কাছ থেকে এধরনের একটি উত্তরে অত্যন্ত বিরক্ত হয়েছিলেন, এবং তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, “তাহলে তুমি কি বিশ্বাস কর?” বিদ্যাসাগর উত্তর দিলেন, “’আমার বিশ্বেশ্বর এবং অন্নপুর্ণা (শিবের স্ত্রী দুর্গা দেবীর আরেক নাম) আমার বাবা আর মা এখানে যারা রক্তমাংসের শরীরে উপস্থিত।” বাবামাকে ঈশ্বরজ্ঞান হিন্দুচেতনার বাহ্যিক প্রকাশ।
বিদ্যাসাগর ছিলেন কর্মবীর। সমাজের বিদ্যমান জ্বলন্ত সমস্যার আশু সমাধান ছিল তাঁর অগ্রাধিকার। কোনো ধর্মাচারের তত্ত্ব মীমাংসা জরুরী ছিলনা তাঁর কাছে । শুষ্ক ধর্মতত্ত্বজ্ঞানের অহংকার তাঁর ছিল না। কিন্তু একথা কখনোই বলা যাবেনা তিনি বেছে বেছে হিন্দু ধর্মেরই সমালোচক ছিলেন আর ঈশ্বরে সম্পূর্ণ অবিশ্বাসী ছিলেন। ইসলাম তো নাস্তিক্যকে ব্ল্যাসফেমি বা ধর্মোদ্রোহীতার দ্যোতক বলে মনে করে আর সেই ব্যক্তিকে বধ করে। হিন্দুত্ব কিন্তু ঈশ্বর-অবিশ্বাসী চার্বাক বা নিরীশ্বরবাদী সাংখ্যকেও স্থান দিয়েছে।
সুদীপনারায়ণ ঘোষ