নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের জঘন্য ধ্বংসযজ্ঞের জন্য বখতিয়ার খলজির (bakhtiyar khilji attacked gauda) কথা সকলেরই জানা, যদিও এটিকে মুছে ফেলার চেষ্টা কম হয়নি। কিন্তু কম সংখ্যক মানুষের জানা আছে যে, তিনি প্রাচীন নগরী গৌড়েও ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছিলেন। নবদ্বীপ (নদিয়া) লুটপাটের পর বখতিয়ার তাঁর লক্ষ্যস্থলে স্থাপন করেছিলেন গৌড়, যা লক্ষ্মণাবতী বা লখনাউতি (মুসলিম কালানুক্রমে) নামেও পরিচিত। গৌড় প্রাচীনকাল থেকেই গৌড় দেশের (বাংলা) ঐতিহাসিক স্নায়ুকেন্দ্র ছিল। কয়েক শতাব্দী ধরে এটি হিন্দু রাজাদের অধীনে বাংলার মহানগর হিসাবে সমৃদ্ধ হয়েছিল।

যখন উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে ঔপনিবেশিক ব্রিটিশরা এর জরিপ করেছিল, তখন স্থানীয় ঐতিহ্য শহরটির সভ্যতার স্মৃতি ধরে রেখেছিল।এটি বিভিন্ন নামে পরিচিত ছিল। যেমন, (১) আদিসুর: বাংলার প্রাচীন রাজা আদিসুরের নামে নামকরণ করা হয়েছে, (২) বল্লালবাটা: সেন রাজবংশের অন্যতম মহান রাজা বল্লাল সেনের নামে নামকরণ করা হয়েছে, (৩) লক্ষ্মণাবতী: বল্লাল সেনের পুত্র লক্ষ্মণ সেনের নামে নামকরণ করা হয়েছে। অতএব নামটি লক্ষ্মণাবতী বা লখনাউতি। লক্ষ্মণ সেনও বাংলায় বখতিয়ার খলজির প্রথম কাফের শিকার ছিলেন। গৌড়ের কীর্তিমান ব্যক্তিত্বরা শহরটিকে এমন প্রতিপত্তি এনে দিয়েছিলেন, নাকি শহরটিই এমন প্রজন্মের কীর্তিমান ব্যক্তিত্বদের জন্ম দিয়েছিল, তা বলা কঠিন। কিন্তু সন্দেহ নেই যে, প্রাচীনকাল থেকেই গৌড়ীয় ব্রাহ্মণরা সনাতন দর্শন, আধ্যাত্মিকতা এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সেরা দিকগুলির প্রসার এবং সংরক্ষণে এক উজ্জ্বল ভূমিকা পালন করে আসছে। প্রকৃতপক্ষে গৌড়ীয় ব্রাহ্মণদের বারবার ব্যাপক অভিবাসন একটি স্বতন্ত্র গবেষণার দাবি রাখে। তাঁদের বংশধররা আজ গোয়া, মহারাষ্ট্র এবং কর্ণাটকের পশ্চিম উপকূলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছেন। তাঁদের প্রজন্মের স্মৃতি সাধারণ উপাধিতে বেঁচে আছে গৌড় সারস্বত ব্রাহ্মণ। গৌড় ছিল বাংলার বিখ্যাত পাঁচ কুলীন ব্রাহ্মণের ঐতিহাসিক স্থানও। উল্লিখিত রাজা আদিসুর পাঁচজন বিশিষ্ট ব্রাহ্মণকে কনৌজ থেকে আমন্ত্রণ করেছিলেন একটি মহান যজ্ঞ সম্পাদন করার জন্য। তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে বিশিষ্ট ছিলেন ভট্ট নারায়ণ, বিখ্যাত সংস্কৃত নাটক ‘ভেনিসাম্বরা’র রচয়িতা। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাঁরা গৌড়কে তাঁদের বাড়ি বানিয়েছিলেন। নালন্দা এবং ওদান্তপুরার মতো গৌড়ও ছিল সংস্কৃত শিক্ষা এবং সাহিত্যের উচ্চতর কেন্দ্র। এ পর্যন্ত এটি যে একমাত্র যুদ্ধ প্রত্যক্ষ করেছিল, তা ছিল তার পণ্ডিতদের মধ্যে সংঘটিত বিতর্ক, যেখানে জ্ঞানই ছিল চূড়ান্ত বিজয়ী। গৌড়ও নালন্দার মতোই একই পরিণতি বরণ করে নিয়েছিল। সেখানেও বখতিয়ার খলজি একই পৈশাচিক পদ্ধতি প্রয়োগ করেছিলেন। বিখ্যাত ইতিহাসবিদ আচার্য যদুনাথ সরকার বর্ণনা করেন কীভাবে বখতিয়ার আক্রমণ শুরু করেছিলেন। তাঁর বর্ণনা, ‘সকল যুগে সভ্য দেশে অভিযানকারী মরুভূমি ও স্তেপের যোদ্ধাদের মতো বখতিয়ারের সেনাবাহিনীও প্রথমে গৌড়ে সরাসরি আক্রমণ না করে খোলা দেশগুলিকে লুটপাট করেছিল।’ এই গৌড় দেশটি মোটামুটি ভাবে একটি বিশাল এলাকা দখল করে রয়েছে। গঙ্গা এবং ব্রহ্মপুত্রের প্রধান চ্যানেলের মধ্যে অবস্থিত একটি সমৃদ্ধ পলিমাটির বিস্তৃতি।
Banglar Loksanskriti Gangatikuri Gramer Shiv Gajon বাংলার লোকসংস্কৃতি গঙ্গাটিকুড়ি গ্রামের শিব গাজন
নবদ্বীপের তুলনায় বখতিয়ারের গৌড়ের ধ্বংসযজ্ঞ ছিল আরও ভয়াবহ। তিনি এই অঞ্চলটিকে নষ্ট করে এবং দখল করে তাঁর কার্যক্রম শুরু করেন। তারপর সরাসরি গৌড় মহানগরীতে চলে যান। বখতিয়ারের পাশবিক যোদ্ধারা তাদের সম্মুখীন হওয়া সমস্ত কাফেরকে হত্যা করে এবং কাফেরদের মূর্তি মন্দির ধ্বংস করে মসজিদ ও অন্যান্য ভবন নির্মাণ করে। গৌড়ের ধ্বংসযজ্ঞ এতটাই ব্যাপক ছিল যে, শহরটির অস্তিত্বের কোনও চিহ্নই অবশিষ্ট থাকেনি। এর সনাতনী অতীতের উন্মেষও বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল। বখতিয়ার খলজির লুণ্ঠন এবং হিন্দুদের ওপর ধর্মীয় নির্যাতন অভিযানের শীর্ষে অবস্থান ছিল গৌড়ের ধ্বংসযজ্ঞ। এই বিজয়ের মাধ্যমেই অবশেষে তিনি আফগানিস্তান থেকেরওনা হওয়ার সময় যে স্বাধীন সাম্রাজ্যের জন্য এতটাই আবুল ছিলেন যে, তা অর্জন করতে সক্ষম হন। একটি নতুন সাম্রাজ্যের জন্য প্রয়োজন একটি নতুন রাজধানী। বখতিয়ার গৌড়ের ধ্বংসাবশেষ থেকে কয়েক মাইল দূরে এটি নির্মাণ করেন। তিনি এর নাম দেন লখনউতি (লক্ষ্মণাবতীর বিকৃতি)। পরবর্তী কয়েক বছর ধরে তিনি তাঁর মোটামুটি বিস্তৃত বিজয়গুলিকে ক্ষমতার সঙ্গে একীভূত করতে বসেছিলেন। এই একীভূতকরণের একটি মূল প্রশাসনিক ব্যবস্থা ছিল এখনও দাঁড়িয়ে থাকা কয়েকটি ‘মূর্তি মন্দির’ ভেঙে ফেলা। সমস্ত বিজয়ী ইসলামি আক্রমণকারীর সাধারণ রীতি অনুসারে তিনি তাঁদের ধ্বংসাবশেষ ব্যবহার করে মসজিদ এবং মাদ্রাসা নির্মাণ করেন এবং রেকর্ড সময়ে পুরো অঞ্চলটি মসজিদ, মাদ্রাসা, মাজার এবং খানকায় ভর্তি হয়ে যায়। আমিররা তাঁর নেতৃত্ব অনুসরণ করে আরও ইসলামি মাদ্রাসা ও কলেজ প্রতিষ্ঠা এবং পৃষ্ঠপোষকতা করে। এই প্রশংসনীয় প্রচেষ্টা তাঁকে ইসলামি ধর্মগুরুদের কাছে অত্যন্ত প্রিয় করে তোলে। তারা ওই প্রতিষ্ঠানগুলিতে বখতিয়ারের ইসলামের প্রতি উদ্যম, অমুসলমানদের ধর্মান্তরিত করার জন্য, পুরো হিন্দুস্থানকে ইসলামিকরণ করার জন্য ব্যবহার করত। বখতিয়ারের রাজ্যে সর্বত্র খুতবা ও আজানে ভরে যায়, মধুর ও সুখানুভূতির বৈদিক মন্ত্রগুলিকে সরিয়ে দেয়, যা এই পূর্বতন সনাতন রাজ্যগুলিকে ধারাবাহিক ভাবে শুদ্ধ ও পবিত্র করে এসেছিল। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে ওই দিব্য স্তোত্রগুলি ঋষিদের সর্বশ্রেষ্ঠ আধ্যাত্মিক উপলব্ধির সংগীতময় প্রকাশ ওই অঞ্চলজুড়ে প্রবাহিত হয়েছিল। যেমন, ভূগর্ভস্থ বৈদিক সরস্বতী নদী। মুসলিম ইতিহাসবিদ বদাউনি বখতিয়ারের এই মূর্তি পূজায় অবিশ্বাসের এবং ধ্বংসের প্রশংসা করেন হৃদয়গ্রাহী একটি চতুষ্পদীতে। তিনি লেখেন, ‘যেখানে আগে কাফেরদের হট্টগোল এবং হইচই শোনা যেত, এখন এখানে আল্লাহু আকবর ধ্বনি ভেসে আসে।’ এই ধ্বংসলীলার ফলে পরবর্তী তিন শতাব্দী ধরে বাংলা দৃঢ়ভাবে ইসলামি অধীনতায় থাকতে বাধ্য হয় এবং তার হারিয়ে যাওয়া সনাতন চরিত্রটি আর ফিরে পায়নি। বিভিন্ন সময় গৌড়ের ভাগ্য এবং এর নামকরণও বেশ কয়েকটি উত্থান-পতন ঘটিয়েছিল। কিন্তু বখতিয়ার যে ইসলামি চরিত্রটি তার ওপর চাপিয়ে দিয়েছিলেন, তা অঞ্চলটিতে স্থায়ীভাবে অঙ্কিত হয়েছিল।
Banglar Loksanskriti Shiv Gajon: বাংলার লোকসংস্কৃতি শিব গাজন
পল্লব মণ্ডল