Saturday, October 4, 2025
HomeMiscellaneousBooks and Book Reviewsমরিচঝাঁপি স্বাধীনোত্তর পশ্চিমবাংলার ইতিহাসে অন্যতম কলঙ্কিত পর্ব Marichjhanpi Refugee Killing

মরিচঝাঁপি স্বাধীনোত্তর পশ্চিমবাংলার ইতিহাসে অন্যতম কলঙ্কিত পর্ব Marichjhanpi Refugee Killing

অবিভক্ত বাংলার মুসলিমরা সংখ্যার শতাংশ হিসেবে হিন্দুদের থেকে মাত্র আট বেশি হওয়ার কী নির্মম পরিণতি হয়েছিল তার অশনি সঙ্কেত হতবাক বিস্ময়ে দেখেছিল ভারত তথা বিশ্ব ১৯৪৬ সালের ১৬-২০ আগস্ট। যে যতই তাত্ত্বিক যুক্তির  ফিরিস্তি দিন মুসলিম ধর্মের মৌলিক নীতির এইটাই স্বাভাবিক পরিণতি ছিল। এ পর্যন্ত গোটা বিশ্বে আটলান্টিক মহাসাগর, ভূমধ্যসাগর, ভারত মহাসাগরের কূল থেকে কূলে বিস্তীর্ণ ভূখণ্ডে নারকীয় হত্যালীলার মাধ্যমে তারা আরব দেশে উৎপন্ন  একদেশদর্শী জবরদস্তি ধারণা চাপিয়ে দিয়েছে (Marichjhanpi Refugee Killing)।
এই চূড়ান্ত একপেশে মতবাদের গবেষণাগার করা হয়েছিল কলকাতা মহানগরকে যা কিনা ব্রিটিশ ভারতে সব রকম প্রগতিশীল আন্দোলন ও চিন্তাধারার সূতিকাগার ছিল। এরপর পূর্ব বাংলার নোয়াখালী, কুমিল্লা, ঢাকা, খুলনাসহ সমগ্র ভূখণ্ডে হিন্দুদের উপর নেমে আসে হাড়হিমকরা গণসংহার। কত সহস্র হিন্দু সর্বস্ব খুইয়ে এপাড়ে চলে আসে তার চুলচেরা হিসাব করা হয়েছে, আরো হবে।
এই দলের মধ্যে একাংশ তাদের পর্যাপ্ত জমি বাড়ি থাকায় সেই সব বিক্রি করে এখানে অনুরূপ সম্পত্তি কিনে গুছিয়ে বসে পড়ে। এরা কোনো দিন ফিরেও তাকায়নি বাকিদের দিকে। এই বাকিদের একাংশ কলকাতার উপকণ্ঠে ফাঁকা স্থান দখল করে কলোনি তৈরি করেছিলেন। সরকার এইসব জমি তাদের নামে পাট্টা দেয়। তারা মালিক বনে যায়। পরবর্তীতে সেই সব জায়গা উন্নত হয়ে বিপুল মূল্যবান সম্পদে পরিণত হয়েছে।
অবশিষ্টাংশকে আন্দামান ও দণ্ডকারণ্যে পাঠানো হয়। এই অঞ্চলটি উড়িষ্যা, অন্ধ্রপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ ও মহারাষ্ট্রের সীমান্ত এলাকায় অবস্থিত– পর্বত-বেষ্টিত, অরণসঙ্কুল, উষর। তার উপর আছে আদিবাসী জনগোষ্ঠী- সমাকীর্ণ প্রতিকূল পরিবেশ।
যে হতভাগ্যদের এইখানে পাঠানো হয় তারা জীবন বাঁচাতে বিকল্প আস্তানার সন্ধান করেছিল এই পশ্চিম বঙ্গের সুন্দর বন এলাকার জনহীন প্রান্তরে।
১৯৭৫ সালে মে মাসে ভিলাইতে গিয়ে তৎকালীন সিপিআইএম নেতা ও পরবর্তীকালে মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু কথা দিয়ে আসেন যে তারা সুন্দরবনের ঐ জনহীন প্রান্তরে গিয়ে বসতি স্থাপন করলে সিপিআইএম তাদের সহায়তা করবে।

Marichjhanpi Refugee Killing
Marichjhanpi Refugee Killing

শ্রী মৃত্যুঞ্জয় প্রামানিকের উপরোক্ত নামের গ্রন্থটির প্রাথমিক অংশে লেখক বিশ্লেষণ করতে চেষ্টা করেছেন বাংলাসহ ভারতভাগের পশ্চাদপট। তবে এর প্রয়োজন ছিল না। বিষয়টি নিয়ে ইতিমধ্যেই বহু পণ্ডিত মানুষ বিস্তৃত চুলচেরা অনুসন্ধান করেছেন। সারমর্ম এই যে মুসলিম ধর্মান্ধতাই এই ভাগের নিহিত কারণ এবং একমাত্র কারণ। যদি ১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীনতালাভের আগের দিন ভারতভাগ না হত তবে কিছু দিন বাদেই সেই যন্ত্রনাদায়ক ব্যবচ্ছেদ ঘটানো হত। জিন্নাহ নামক সেই গণহত্যার নায়ক বলেছিলেন, “আমরা হয় ভারত ভাগ করব না নয় ভারত ধ্বংস করব।” তাঁদের সর্বাত্মক সহায়তা দিয়েছিল কমিউনিস্টরা। এরা মুসলিম লীগের ছদ্মবেশ।
কিন্তু আলোচ্য গ্রন্থের পরবর্তী অংশ বিশেষ নিবিড় মনোযোগ আকর্ষণ করে।
প্রথমত ভারত সরকার ও তদানীন্তন পশ্চিমবঙ্গ সরকার উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনের জন্য যে তিনটি অঞ্চল নির্বাচন করেছিলেন তার মধ্যে দণ্ডকারণ্য ছিল সবচেয়ে অনুপযুক্ত ও অবিবেচনাপ্রসূত। ঐ অঞ্চল নানা কারণে বাঙালি উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনের পক্ষে অসম্ভব ছিল। প্রথমত জায়গাটি রুক্ষ, পাথুরে জমি। ওখানে মাটিকে শস্যফলনের উপযোগী করা ভীষণ কষ্টকর। দ্বিতীয়ত ওখানে পানীয় জলের অভাব, প্রতিকূল পরিবেশ, স্থানীয় জনগণের অসহযোগিতা, এবং বিশেষত উড়িষ্যার মালকানগিরিতে সংশ্লিষ্ট রাজ্য সরকারের প্রকল্প রূপায়ণে অনীহা, গড়িমসি ও বৈমাতৃক আচরণ। তবুও যারা কষ্ট করে ছিল তাদের প্রাণ ধারণের ন্যূনতম শস্য ফলন দরকার ছিল ষাট মণ সেখানে অনেক চেষ্টা করেও তারা তিরিশ চল্লিশ মণের বেশি শস্য ফলাতে পারত না। তাঁরা  মাসে পরিবারপিছু ৭৮ টাকা ডোল পেতেন এবং অর্ধমৃত অবস্থায় দিন কাটাতেন।
বামফ্রন্ট মন্ত্রী দেবব্রত সরকার-সহ প্রতিনিধি দল দণ্ডকারণ্য গিয়ে উদ্বাস্তুদের প্রতিশ্রুতি দেন মরিচঝাঁপিতে তাঁদের পুনর্বাসন দেওয়ার। ১৯৭৮ সালের মার্চে লক্ষাধিক উদ্বাস্তু ট্রেনে করে বর্ধমান, হাওড়া, বালি ব্রিজ হয়ে পুলিশের চোখ এড়িয়ে হাসনাবাদ পৌঁছে সেখান থেকে দেশি নৌকোয় মরিচঝাঁপি পৌঁছন। তার আগে উদ্বাস্তু নেতারা সেখানে সব পরিকল্পনা করেছিলেন।

Marichjhanpi Refugee Killing
Marichjhanpi Refugee Killing

তাঁরা অকল্পনীয় পরিশ্রম ও যৌথ উদ্যোগে এক স্বয়ংসম্পূর্ণ বসতি গড়ে তোলেন।

বামফ্রন্ট সরকার তীব্র বিরোধিতা করেন। তাদের উত্থাপিত সমস্যাগুলো ভিত্তিহীন। মরিচঝাঁপি দ্বীপ ব্যাঘ্র প্রকল্পের অন্তর্ভুক্ত ছিল না। এই দ্বীপে ছোট ও কম দামি গাছ ছিল। সুতরাং বনধ্বংস করার প্রশ্নই ওঠে না। কিছু সরকারি অফিসার ও শাসক দলের নেতাগণ যোগসাজশ করে বাংলাদেশের সঙ্গে ঐ দ্বীপে চোরাকারবারি চালাত। উদ্বাস্তুরা আসার পর তা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। তাই উদ্বাস্তুদের বিতাড়ন অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে।
বাংলাভাগের সময় ৩২,৬২,৯৫২ জনকে  পুনর্বাসন দেওয়া হয়েছিল। তার সঙ্গে আরো ৩০-৪০ হাজার উদ্বাস্তুকে মরিচঝাঁপিতে  বসবাস করতে দিলে কোন জনবিস্ফোরণ ঘটত না। লেখক নিটোল যুক্তিসহ দেখিয়েছেন যে মূল কারণ ছিল এই উদ্বাস্তুরা সিপিআইএম দলের বারংবার ঐ দলে যোগদান করার আহ্বান প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। তাঁরা কোনো দলের সহায়তা ব্যতিরেকে নিজ উদ্যোগে সুন্দর বসতি স্থাপন করেছিলেন। এই ব্যাপারটা সিপিআইএম সহ্য করতে পারেনি। কারণ এতে করে ওদের সম্মান হানি ঘটেছিল। দল ভেবেছিল এইটা মেনে নিলে বাকিরা তাই অনুসরণ করবে। এর ফলে দলের বজ্রমুষ্টি শিথিল হবে। উদ্বাস্তুরা যুক্তি দিয়েছিল তাদের সমস্যা জাতীয় সমস্যা কোনো স্থানীয় দলকে সেখানে ঢুকতে দিলে সেটা স্থানীয় সমস্যা থেকে যাবে। একদম সঠিক যুক্তি। কিন্তু কা কস্য পরিবেদনা!
১৯৭৮ সালের এপ্রিল থেকে ১৯৭৯ সালের মে পর্যন্ত তেরো মাস ধরে উচ্ছেদ অপারেশন চলে। জীবনধারণের সব পথ বন্ধ করে তাদের মারা হয় এবং বিষয়টি চরমে ওঠে ৩০শে জানুয়ারি,১৯৭৯।  তার আগে ২৪-২৯ জানুয়ারি দ্বীপটিকে অবরুদ্ধ করে রাখা হয়।

The Koch Kingdom Part 1

উদ্বাস্তুরা গাছের পাতা চিবিয়ে খেয়ে কোনো রকমে জীবন রক্ষা করেছিল। ঘরে ঘরে কান্নার রোল পড়েছিল। ৩০শে জানুয়ারি মরিচঝাঁপি দ্বীপটিতে সরাসরি আক্রমণ চালানো হয়। পুলিশ সুপার অনিল কুমারের নেতৃত্বে ২৪-২৫টি টিয়ারগ্যাস সেল উদ্বাস্তুদের হোগলার ঘরে পড়লে তাদের বাড়িতে আগুন ধরে যায়। তারা যদু পালং, ঝাউ পাতা, বুনো ফুল, হেতাল গাছের মেথি খেয়ে কোনো রকমে দিন কাটাতে থাকে।
এই পরিকল্পনায় ছিলেন সিপিআইএমের বিনয় চৌধুরী, আরএসপির দেবব্রত সরকার, অশোক ঘোষ, ফরোয়ার্ড ব্লকের দেবব্রত মণ্ডল ও সর্বোপরি জ্যোতি বসু। ১৩-১৬মে উদ্বাস্তুদের ১০০০ বাড়ি ভেঙে ও ৩০০ বাড়িতে আগুন লাগিয়ে, বেপরোয়াভাবে লাঠি চালিয়ে, সব মালপত্র লুঠ করে শিশু-নারী-বৃদ্ধ সবাইকে জোর করে লঞ্চে তুলে হাসনাবাদ থেকে ট্রেনে করে দণ্ডকারণ্যে ফেরত পাঠানো হয়। ১৭ইমে সরকারি ঘোষণা করা হয় মরিচঝাঁপি উদ্বাস্তু শূন্য হয়েছে।
কোনো স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা বা সংবাদ মাধ্যমকে কাছে ঘেঁষতে দেওয়া হয়নি।
এই পুস্তকে উপরি পাওনা হল এই অসহায় লড়াকু জনগোষ্ঠীকে নির্মমভাবে দমন করার পিছনে সিপিআইএম নেতৃত্বাধীন বামফ্রন্টের এক হীন দলতন্ত্রের ক্রম-উন্মোচন যার ফল স্বাধীন ভারতে বৃহত্তম সরকারি গণহত্যা। এবং কাদের দ্বারা? যারা নিপীড়িত জনগণের মুখ বলে দাবি করে। লেখকের বিশ্লেষণ পদ্ধতি অত্যন্ত সুবিন্যস্ত, তথ্যভিত্তিক, যুক্তিনির্ভর। আবেগহীন এই স্বল্পদৈর্ঘ্যের গ্রন্থটির প্রতিটি ইতিহাস গবেষক ও বাঙালির অবশ্য পাঠ্য। পরবর্তী সংস্করণে মুদ্রণপ্রমাদের দিকে নজর দিলে ভাল হয়। গ্রন্থটির সাফল্য কামনা করি।

মরিচঝাঁপি উদ্বাস্তু বিতাড়ন ও গণহত্যার ইতিহাস – মৃত্যুঞ্জয় প্রামাণিক
সুদীপনারায়ণ ঘোষ
১২/০৭/২০২৫

RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Most Popular

Recent Comments