কলকাতার অজানা রাস্তায় একদিকে অশ্রু অপরদিকে ছেড়ে আসা প্রিয় মাতৃভূমিতে থাকা মা বাবার জন্য বুকফাটা যন্ত্রণা…..
আমাদের বাড়ি ছিল বাংলাদেশের খুলনা জেলার একটি গ্রামীণ শহরে। বাড়িটি ছিল অনেক বৃহৎ তাতে ছিল একটি পুকুর ও প্রচুর গাছ।আমার বয়স ছিল চৌদ্দ অথবা পনেরো। মনে পরে বৃষ্টির দিনে বড়শিতে চার লাগিয়ে তালগাছের তলায় বসিয়ে রেখে আসতাম।কিছুক্ষন পর পর বড় মানকচুর পাতা মাথায় দিয়ে যেতাম ,দেখতাম মাছ বেঁধে থাকতো।
বাবা যখন বাড়ি আসতেন আমরা সব ভাইবোনেরা বাবাকে ঘিরে ধরতাম। বাবা সবসময় আমাদের লেখা পড়া করতেন র বলতেন ” ” অশিক্ষিত পুত্র – যমদূত সম”! কথাটির মানে বুঝতাম না , তবুও পড়াশোনা করতে ও স্কুলে যেতে ভালো লাগতো।
তখন একাত্তর সাল – বাংলাদেশে তখন বিদ্রোহের সময়। একদম শুরুর দিকের একটি প্রভাতে আমদের চেনে দুজন ব্যাক্তি যারা তখন “রাজাকার” – বাবাকে গুলি করে হত্যা করে। আমি আর আমার বড়দা সেখানেই উপস্থিত ছিলাম, আমি কিছুই বুঝতে পারিনি। মারণাস্ত্র তুলে ধরতে দেখে দাদা তাদের পা জড়িয়ে ধরে দয়া ভিক্ষা করেন ” আমাকে মারুন, আমার বাবাকে না…” ওরা দাদাকে পা দিয়ে মেরে সরিয়ে দিয়ে গুলি চালাতে থাকে।
আমি দৌঁড়ে বারান্দায় যাই সেখানে কোণে রাখা জল বাবার মুখে ঢেলে দেই। ঐ জলটি ছিল বেশ কয়েকদিন আগের দেশের মহামারির কারণে মায়ের সংসার ভালো মতো চলছিল না , তাই জলটি অপচয় করা হয়নি।
এরপর আমাদের বাড়িটা দেশদ্রোহীর বাড়ি, বিহারী ও পাকিস্তানি সৈন্যদের নজরে আসে। তারা আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামী মনেকরে নজরে রাখে। আমাদের যে কোনো দিন হত্যা করা হবে এ কথা আমার মা বুঝতে পারেন।
আমাদের বাসভবনের কিছু দূরত্বে ছিলেন পড়শী নারায়ণ সম্মাদারের গৃহ। ভালো সম্বন্ধ ছিল। তারা আগেই কোথাও যেন নিখোঁজ হয়ে যান। ভারতে ভবঘুরে আগে একদিন গোপনীয় ভাবে মায়ের সহিত সাক্ষাৎ করতে এলে মা মিনতি করেন আমকেও নিয়ে যেতে।মা আমাদের পৃথক ভাবে পাঠাতে চেয়েছিলেন, যাতে পথে কোনো জোটের আক্রমণ হলে আমরা কেউ না কেউ বেচেঁ থাকি । যাওয়ার দিন মা একটু নুন ভাত খাইয়ে আর
দুটো জামা ও পায়জামা বোঁচকা আমার হাতে দিয়ে দেন। আর ঠাকুরদার সেই বাসস্হানের বিবরণ খুড়োর কাছে দেন।
মায়ের বাবার মৃত্যু হয় চৌষট্টি সালের যুদ্ধের সময়। তাঁদের সঙ্গে মায়ের কয়েক বছর কোনো আদান-প্রদান ছিলনা ডাক ব্যাবস্থা বন্ধ থাকার জন্য। আমি খুব কাঁদে ছিলাম কারণ বাবাকে খুব ভালোবাসতাম আর এখন মা আর ভাইবোনদের ছেড়ে আমি কোথায় যাবো। দিকভ্রষ্ট আমি! চোখে জল থাকা অবস্থায় নারায়ণ সমাদ্দারের মায়ের হাতে আমাকে হস্তক্ষেপ করে মা পিছু ফিরে ক্রন্দিত অবস্থায় দাঁড়িয়ে ছিলেন। এরপর বহু বছর পর মায়ের সাথে আবার দেখা হয়।
আমরা ঢাকা রিক্সা করে বাড়ি থেকে বাগেরহাট স্টেশনে এসে ট্রেনে করে ফকিরহাট খুড়োর দিদির বাড়ি গেলাম।সেখানে আগেই তাদের চেনা জানা অনেক মেয়েদের নাট্যশিল্পী হাজির ছিল।তখন বর্ষাকাল – ভদ্রমাস। সারাটাদিন বৃষ্টি হচ্ছিল। সেইদিন ওখান থেকে পরবর্তী দিন বিকেলে আমরা সবাই, মানে নারায়ণ বাবুর পত্নী, তার দুটি বাচ্চা, আমি আর নাট্যশিল্পীর কমবয়সী কটি মেয়ে নলদায় পৌঁছবার জন্য একটি নৌকায় উঠলাম।
নদীর ধারে আরেকটি নৌকা যাত্রী প্রতীক্ষা করছিল।আমরা শিবসা পশর পৌঁছে দীর্ঘ পাঁচ দিন হাঁটা শুরু করি।সূর্যাস্ত হলে কখনো খালি বিদ্যালয়ে শরণ নিতাম।সেই সময় একবারের জন্য রন্ধন হত।সেখানকার মুসলিম প্রজাতির মানুষেরা চল ডাল তেল আর লণ্ঠনের ব্যাবস্থা করে দিতেন। প্রভাতে দেখতাম বিদ্যালয়ের দেওয়ালে আগে যারা গেছেন তাদের নাম ঠিকানা লিখে রেখে গেছেন যাতে পরবর্তী সময় তাদের আত্মীয় পরিজন যারা যাবে তারা যেন কিছু জল খাবার পান। বহু স্থানে লেখা থাকতো , অমীককে হত্যা করেছে…..। আমি একটা লাল পাথরের খন্ড খুঁজে বেড় করলাম আর চোখের জল মুছতে মুছতে আমার বাসস্থানের নাম আর বাবার নাম আর পাশে জোড়া দিয়ে লিখেদিতাম ” তোমাকে ভুলে যায়নি”।
এরপর আবার হাঁটার পথ অনেক মাইল পর্যন্ত। আমার পা ফুলে গেলো, গায়ে তখন জ্বর। ভীত হতাম এটা ভেবে যে যদি খুড়ো আমায় ছেড়ে চলে যান। এমন ভাবে হয়তো একদিন যশোর- নড়াইলে পৌঁছলাম,তবে মাঝে মধ্যেই সেই স্থানের দেশদ্রোহীরা নৌকায় উঠত। তাদের যাদের যা ইচ্ছা লুটে নিয়ে যেত।যেমন আমার জামা আর পায়জামা গুলো এছাড়া নাট্য দলের মেয়েদের ও নিয়ে যায় একে একে। তাদের কান্নার আওয়াজ আজও কানে বাজতে থাকে।
তিনদিন পরে এক বৈকালে আমরা এক ভষ্মিভূত বাজারে আরও অনেক রিফিউজিদের সাথে রাত কাটাই।সেইদিন আমরা যে গ্রামে প্রথমে যাই , সেটা দেশদ্রোহীদের আসল জায়গা হওয়ায় আমরা সেখান থেকে পালিয়ে আসি।তখন প্রায় আগারো বারো দিন কেটে গেছে।বর্ষা, চারিদিক জল আর জল। যেই দিকেই তাকাই যেন মনে হয় সাগর, হাওয়ার কারণে নৌকা মনে হয় ঢেউ খায়। ঐ অঞ্চল প্রায় ভারতের সীমানার কাছাকাছি। তবে এর মধ্যেই মাঝে মাঝে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের সাহায্য আমরা পাই।
তারপর একদিন পনের দিন পর সব শেষ হয়ে রিফিউজি নামে ভারতের মাটিতে পা রাখি। আমি তখন বুদ্ধিহীন এক ছেলে। এরপর অনেক কষ্টে সেই বাসস্থানে পৌঁছাই। তা অন্য এক গল্প ।
কলকাতার অজানা পথ দিয়ে হাঁটতাম আমি। নয়ন অশ্রু হৃদয়ে এসে ভাসত । মা এর কথা ছুটে যাওয়ার খুব শখ নিয়ে সূর্যকিরণে জলভ্রমের মত ঘুরে বেড়াতাম। আর মনে মনে চিন্তা করতাম, ঈশ্বর যদি ক্ষমতা দিতেন তবে আমরা জীবনের এর নিষ্টুর ঘটনার জন্য যারা দায়ী তাদের কঠোর শিক্ষা দেবো। আবার মা বাবার কথা মনে রেখে কোনো দিন বাজে এবং হিংসার রাস্তায় যাইনি।
আজও দিনের অন্তিমে যখন বালিশে মাথা রাখি চোখে ঘুম আসে না কিছুক্ষণ । মা – বাবা চোখের সামনে দেখতে পাই। নাট্য দলের মেয়ে গুলোর কান্নার আওয়াজ শুনতে পাই! সবচেয়ে বেশি দুঃখ লাগে এটা ভেবে যে যেদিন তারা এই সব করেছিল তারাও বাংলায় কথা বলছিল…। পশ্চিমের পাকিস্তানি হলে এতো কষ্ট হতো না। অবশ্য দেশদ্রোহীরা না থাকলে এতো নির্যাতনও হত না।
তবুও কি অবাক করা সবার অন্তিমে সেই পুকুর – তালগাছ আর মাছ ধরার কথা গুলি বারং বার মনে পড়ছে। সেখানে যাওয়ার জন্য মন টানছে না আবার টানছে। সে যে আমার মাতৃ ভূমি ফেলে আসা মাতৃ ভূমি…….