-স্মৃতিলেখা চক্রবর্ত্তী
(লেখাটি স্মৃতি ও চেতনা আয়োজিত পশ্চিমবঙ্গ দিবস প্রবন্ধ প্রতিযোগিতায় প্রথম স্থান গ্রহণ করেছে)
বাংলার বাইরেও যে বাঙ্গালী থাকে, অনেকেই জানেন না। দেশভাগের বিপুল চাপে যে লক্ষ-কোটি বাঙালী উদ্বাস্তুর ঢেউ ভারতবর্ষে আছড়ে পড়েছিল, তাদের একটা অংশ পশ্চিমবঙ্গে জায়গা পায়নি। তাদের যেতে হয়েছিল দণ্ডকারণ্যে। কেউ ঠাঁই পেয়েছিল কর্ণাটকের রায়চুরে। কেউ আবার উড়িষ্যার কালাহান্ডির কাছে। এসব জায়গায় বিশেষত্ব হচ্ছে যে এদের জলহাওয়ার সাথে বাংলার পরিবেশের প্রায় কোন মিল নেই। প্রান্তিক বাঙ্গালীর বিরাট অংশের জীবন-জীবিকা জলের উপর নির্ভরশীল। সুজলা-সুফলা বঙ্গভূমিতে জলের কোন অভাব নেই। সেজন্যেই বাঙ্গালীর প্রিয় খাবার মাছ-ভাত হতে পেরেছে। কারণ ধান চাষে প্রচুর পরিমাণ জল লাগে আর মাছকে তো চলতি কথায় “জলের ফল” বলা হয়। আর এই মাছ ধরা আর যাতায়াতের জন্য বাংলায় নৌকা শিল্প তৈরি হয়েছে। বাংলার ভূগোল এবং প্রকৃতি এভাবেই বাঙালির সাংস্কৃতিক সীমা বেঁধে দিয়েছে।
অথচ দেশভাগের পর বহু বাঙালী উদ্বাস্তুকে বেছে বেছে সেসব রাজ্যের সবথেকে শুকনো জায়গায় পাঠানো হল। যেখানে মাটিতে ঘটি ঠোকাও যা, দেয়ালে মাথা ঠোকাও তা। এক ফোঁটা জল কোথাও থেকে বেরোবে না। এই মাটিতে ধান চাষ তো দূরের কথা, জোয়ার-বাজরা-রাগী চাষ করতেও কষ্ট হবে। তাহলে ভেতো বাঙ্গালী খাবে কি? বাঙ্গালী তো চাল দিয়ে শুধু দুপুরের ভাত খায় না। সকালের চিড়া বা বিকেলের মুড়ি, পিঠা, বড়া, ফুলুরি, সবেতেই চাল লাগে। তাই এরকম শুকনো জায়গায় নিজেদের খাদ্যাভ্যাস টিকিয়ে রাখার জন্য বাঙ্গালী উদ্বাস্তুদের মরণপণ সংগ্রাম করতে হয়েছিল। পশ্চিমবঙ্গের বাকি বাঙ্গালীরা খোঁজ রাখেনি কিন্তু তাঁরা নিজেদের শিকড় ভুলতে পারেননি। তাই বিগত পঞ্চাশ বছর ধরে যুদ্ধ করে মহারাষ্ট্র এবং কর্ণাটকের বাঙ্গালী কলোনীগুলোতে আদায় করেছেন বাংলায় স্কুলে পড়ার সুযোগ।
বাঙ্গালী নিজেই নিজেকে বলে “কাঁকড়ার জাত”। একটা বাঙ্গালী উঠতে গেলে আরেকটা বাঙ্গালী তাকে টেনে নামিয়ে দেয়। বাঙ্গালী একা একশো হতে পারে কিন্তু একশটা বাঙালি কিছুতেই এক হতে পারে না। শ্যামাপ্রসাদ কিন্তু এক করতে পেরেছিলেন। তাঁর নেতৃত্বে যে “বেঙ্গলি হিন্দু হোমল্যান্ড মুভমেন্ট” শুরু হয়েছিল, সেটা বাঙ্গালী নেতাদের মধ্যে সমস্ত রাজনৈতিক ভেদাভেদ ভুলে তাদেরকে মিলিয়ে দিয়েছিল। তাই, কংগ্রেস, মার্ক্সবাদী, হিন্দু মহাসভা ইত্যাদি সমস্ত বাঙালি হিন্দু নেতারা মিলে পশ্চিমবঙ্গ সৃষ্টির পক্ষে ভোট দিয়েছিলেন। রাজ্যটা তৈরি হয়ে প্রায় ৭৫ বছর হয়ে গেল। তবু এখনো আমরা না রাজ্যটার সঠিক মূল্যায়ন করতে পেরেছি আর না এই রাজ্যের জনকের। আমরা জানিও না যে আমাদের ছোট-বড় প্রতিটা মেলা, খেলা, পুজো, উৎসবের পিছনে একজনই শ্যামাপ্রসাদ আছেন। তাঁর প্রবল জেদে এই রাজ্যটা তৈরি না হলে কোথায় হত কলকাতার দুর্গাপুজো, মাহেশের রথের মেলা, চন্দননগরের জগদ্ধাত্রী পূজা, মায়াপুরের ইসকন মন্দির? সিপিএম-তৃণমূলে দলাদলি তো দূরের কথা, রাজনৈতিক ভাবেই বাঙ্গালী জাতিটা সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ত। বাঙ্গালী মানে যে আসলে বাঙ্গালী হিন্দু, সেটা জোর গলায় বলারও কোন জায়গা থাকত না। কারণ যে জাতির মাটি নেই, তার তো কিছুই নেই।
ঠিক এই কারণেই বাংলার বাইরে যাওয়া বাঙ্গালী উদ্বাস্তুদের খোঁজ আমাদের রাখা উচিত ছিল। দেশভাগের পর থেকে আজ পর্যন্ত যত উদ্বাস্তু ভারতে আশ্রয় নিয়েছে তার সিংহভাগই এসেছে পশ্চিমবঙ্গে। এসেছে, নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেছে আর পালিয়ে আসার কারণ ভুলে গেছে। পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যটা যে একটা বিশেষ কারণে একটা বিশেষ পরিস্থিতিতে তৈরি হয়েছিল সেটা আর আজ কারুর মনে পড়ে না। পশ্চিমবঙ্গ সহ গোটা বাংলাটাই যখন জিন্নার পাকিস্তানে বিলীন হতে চলছিল, তখন কতটা লড়াই করে শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জির নেতৃত্ব বাঙ্গালী হিন্দুর আপন ভূমি হিসেবে পশ্চিমবঙ্গ সৃষ্টি হয়েছিল, সেই ইতিহাস আজ বিস্মৃত। সেজন্যই আরো বেশি করে বাঙ্গালীর উচিত দণ্ডকারণ্য, কালাহান্ডি, রায়চুরের উদ্বাস্তু কলোনীগুলোতে যাওয়া। তাদের সমস্যা স্বচক্ষে দেখা। হয়তো তাহলেই আমরা উপলব্ধি করতে পারব, একজন শ্যামাপ্রসাদের সার্থকতা। কারণ এই রাজ্যটা সৃষ্টি না হলে সব বাঙ্গালীর ঠিকানা হত এরকমই কোন দণ্ডকারণ্য। এই সহজ সত্যটা শিখতে না চাইলে দণ্ডকারণ্যই আমাদের ভবিষ্যৎ হতে চলেছে। অতএব ঠেকে শেখার থেকে অন্ততঃ দেখে শেখা তো ভাল।
লেখক পরিচিতিঃ স্মৃতিলেখা চক্রবর্তী একজন লেখিকা এবং আইনজীবী। বসবাস মহারাষ্ট্রে।