Tuesday, November 5, 2024
HomeUncategorizedআরবায়ন থেকে বঙ্গায়ন-এর পথে

আরবায়ন থেকে বঙ্গায়ন-এর পথে

  • স্মৃতিলেখা চক্রবর্তী

(প্রবন্ধটি স্মৃতি ও চেতনা আয়োজিত রাজেশ সরকার স্মৃতি পুরস্কারে দ্বিতীয় স্থান গ্রহণ করেছে।)

১৪৫৩ খ্রিস্টাব্দে গ্রীসের পতন ঘটার সাথে গ্রীক ভাষা ও সংস্কৃতির ভয়ানক সংকট দেখা দেয়। বিজয়ী অটোমান তুর্কিরা কেবল গ্রীসের মাটি দখল করেই ক্ষান্ত হয়নি, গ্রীক ভাষার মধ্যে তারা মিশিয়ে দিতে লাগল তুর্কির চোনা। সাড়ে তিনশো বছর পর, রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে গ্রীস যখন স্বাধীন হল, গ্রীক ভাষাকে তখন আর চিনবার উপায় নেই। সে ভাষার ততদিনে আধা তুর্কীকরণ হয়ে গেছে। এইখান থেকেই গ্রীক ভাষাবিদরা শুরু করলেন বৌদ্ধিক লড়াই। নিজেদের ভাষাকে বিশুদ্ধ করার লড়াই। বিদেশী দখলদার তুর্কি প্রভাব থেকে গ্রীক ভাষাকে মুক্ত করার লড়াই। অটোমান সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হবার আগে যত প্রাচীন পুঁথিপত্র লেখা হয়েছিল গ্রীক ভাষায়, সমস্তটা খুঁজে খুঁজে বের করা হতে লাগল। মহাকবি হোমারের লেখা ইলিয়াড, ওডিসি, মহাজ্ঞানী সক্রেটিস, প্লেটোর দার্শনিক তত্ত্ব, এরিস্টটল-এর রাজনৈতিক বিদ্যা, গ্রীক পুরাণ এবং বাইবেল ইত্যাদির রচিত পুঁথির উপর ভিত্তি করে চিহ্নিত করা হল আদি এবং অকৃত্রিম গ্রীক ভাষার শিকড়। নতুন ভাবে লেখা হতে লাগল গ্রীক অভিধান। ধীরে ধীরে সেই অভিধানে যোগ করা হল স্থানীয় চলিত শব্দগুলো। এইভাবে বহু বছরের অক্লান্ত পরিশ্রমে জন্ম নিল আধুনিক গ্রীক ভাষা। যে ভাষা একান্ত ভাবেই গ্রীসের মাটি ও সভ্যতার সাথে সম্পৃক্ত। 
গ্রীক ভাষার এই পুনর্গঠন বিশ্বের প্রত্যেকটি পরাধীন জাতির প্রেরণা। যে জাতিই কখনো না কখনো অন্য জাতির অধীনে এসেছে, তারাই জানে ভাষার শুদ্ধতা ধরে রাখা কতটা কঠিন কাজ। কারণ বিজয়ী জাতি নানাভাবে বিজিত জাতির উপর নিজের ভাষা চাপিয়ে দেয়। নবাব-বাদশারা যখন বাংলা শাসন করেছেন, দরবারী ভাষা ছিল ফার্সী। রাজসভায় কাজ পেতে গেলে বাঙালিকে ফার্সী শিখতে হত। অভিজাত বাঙালি ফার্সী শিখল, নবাবের দরবারে কাজ পেল। কাজ করতে করতে, ফার্সী বলতে বলতে অনেক বিদেশী শব্দ বাংলায় ঢুকতে লাগল। আইন-আদালতের সমস্ত পরিভাষা হল ফার্সিতে। নবাবী ভূমি রাজস্ব দপ্তরের সৌজন্যে ভূমি সংক্রান্ত বহু শব্দ থেকেও বাংলা বাদ চলে গেল। ভূমি হল জমি, সেই জমির কাগজ হল দলিল, বিধি হল আইন-কানুন, বিচারসভা হল আদালত, আদেশপত্র হল হুকুমনামা, অনুমতি হল পরোয়ানা। কর আদায়ের সুবিধার্থে বঙ্গভূমিকে ছোট ছোট অংশে ভাগ করা হল। সুবা, পরগণা, মৌজা ইত্যাদি। এই শব্দগুলোও অবাংলা। 
সরকারি ভাবে তৈরি করা শব্দ বাধ্য হয়েই ব্যবহার করতে হল ভূমিপুত্র বাঙালিদের। এভাবেই ধীরে ধীরে সশব্দে পাল্টাতে লাগল বাংলা ভাষার চরিত্র। দেশের রাজত্ব যখন ইংরেজদের হাতে গেল, রাজভাষা পাল্টে হল ইংরেজি। ফার্সী জানা বাঙালি দৌড়ল খুব করে ইংরেজি শিখতে। ভাষা সংস্কৃতির বাহন। বাঙালি যত ইংরেজদের সাথে মিশল, তাদের সংস্কৃতি রপ্ত করল; ততই বাংলাতে যুক্ত হল একের পর এক ইংরেজি শব্দ। কাপ, প্লেট, চেয়ার, টেবিল, প্যাকেট, ক্যালেন্ডার ইত্যাদি। তবে কিছু কিছু বাঙালি এমন গভীর ভাবে ইংরেজি শিখল যে ভাষার অন্যান্য ক্ষেত্রেও ইংরেজি ঢুকতে লাগল। ঘৃণা করা হল hate করা, কাউকে খ্যাপানো হল leg pull করা। দেশ স্বাধীন হল কিন্তু ইংরেজিকে সরানো গেল না। উল্টে তার সঙ্গে এসে জুটল আমির খসরুর অদ্ভুত আবিষ্কার, হিন্দভি বা হিন্দি ভাষা। বাঙালিদের মধ্যে বলিউডি সিনেমা-সিরিয়াল দেখার মোহ থেকেই কথ্য বাংলায় আবার ফিরে আসা শুরু করল আরবী-ফার্সী শব্দগুলো। সতর্কতা হল চেতাবনী, ভড়ং হল জুমলা, মুরোদ হল আওকাত, মাথা ঘোরা হল হোশ ওড়া। এমন কি, অশ্রাব্য গালাগালি দিতে হলেও বঙ্গসন্তানদের এখন প্রথম পছন্দ  হিন্দি গালি। 

কথা বলার জন্য, মনের ভাব প্রকাশের জন্য একটা ভাষা যখন অন্য ভাষার উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে; তখন ভাষার গতি রুদ্ধ হয়। পরনির্ভরশীল ভাষা সময়ের সঙ্গে তাল মেলাতে না পেরে একসময়ে হারিয়ে যায়। হয়তো সেই লক্ষ্যেই সজ্ঞানে বাংলা ভাষার আরবায়ন করে চলেছে আরবপন্থী বাংলাভাষীর রাষ্ট্র বাংলাদেশ। গায়ের জোরে বাংলা ভাগ করে তার বৃহত্তর অংশ পাকিস্তানের হাতে তুলে দেবার পরই যার সূচনা। বাংলা ভাষাকে “পাক” বানানোর জন্য ২৫%-৩০% আরবী/ফার্সী শব্দ ঢোকানো হয়। যাকে সফলভাবে এগিয়ে নিয়ে চলেছে স্বাধীন বাংলাদেশের সব সরকার। 
 ভাষার এই আরবায়ন রুখতে হলে বাঙালিদের মধ্যে ইতিহাস চর্চা চাই। বাংলার আদিরূপকে বিকৃত কিভাবে করা হল, সেই বিষয়ে যথেষ্ট জ্ঞান না হলে, পরবর্তী ধাপ নিয়ে আলোচনা এগোবে না। ভাষা বিকৃতির বিরূপ প্রভাব একটা জাতির কতটা ক্ষতি করতে পারে, সেই নিয়ে জাতিগত সচেতনতা অবশ্যই দরকার। তবে তার থেকেও আগে দরকার শব্দের ভাণ্ডার বাড়ানো। বাংলা ভাষায় শব্দ ভান্ডার বাড়ানোর জন্য অন্য কোন ভাষা থেকে শব্দ ধার করার দরকার নেই। বাংলা অত্যন্ত সমৃদ্ধ ভাষা। স্থানীয় চলিত বাংলা থেকে অজস্র শব্দ আমরা পেতে পারি, যেগুলোর সাহায্যে বাংলা ভাষাকে আরবি-ফার্সী, উর্দু-ইংরেজির প্রভাব মুক্ত করা অবশ্যই সম্ভব। 
বাংলা ভাষার প্রধান সমস্যা হল স্থানীয় চলিত শব্দ গুলোকে বাংলা অভিধানে জায়গা না দেওয়া। স্থানীয় শব্দ যোগ করা হলে, বাংলা ভাষায় শব্দের সংখ্যা বহু গুন বেড়ে যাবে। উর্দু আওকাত-এর বাংলা প্রতিশব্দ একটা নয়, অনেক গুলো আছে। রাঢ় বাংলায় একে যেমন মুরোদ বলা হয়, মান্য বাংলায় একে বলে ক্ষমতা, তেমনি পূর্ব বঙ্গের হিন্দুরা একে বলতেন হ্যাডাম। “জমি”-কে বাংলার বিভিন্ন জায়গায় মাটি বা ভূমি বলা হয়। জমি কথাটা পার্সি জমিন থেকে এলেও ভূমি বা মাটি কিন্তু খাঁটি স্বদেশী শব্দ। বহু ইংরেজি শব্দের সফল বাংলায়ন করেছেন ভূমিপুত্র সাধারণ বাঙালিরাই। মোবাইল ফোন হয়েছে “হাতফোন”, মোটর সাইকেল হয়েছে ভটভটি, মোটর বোট হয়েছে ভুটভুটি, কন্ট্রাসেপ্টিভ পিল হয়েছে সতী-বড়ি। এই শব্দগুলোকে সরকারি ভাবে, সসম্মানে ভাষার মধ্যে জায়গা না দিলে, শব্দ গুলো হারিয়ে যাবে। তখন আবার অন্য ভাষা থেকে শব্দ ধার করতে হবে। ভাষা দাসত্ব এভাবেই শুরু হয়। ভাষার মুক্তি গণ-মানুষের হাতে। স্থানীয় জনগণ যে বাংলায় কথা বলেন, তাকে যথাযথ সংরক্ষণ করা গেলেই ভাষা আবার স্বাধীন হবে। গ্রীকরা এই পথেই হেঁটেছেন, বাংলারও মুক্তি এই পথেই হবে।

লেখক পরিচিতি: স্মৃতিলেখা চক্রবর্তী একজন রক্ষণশীল চিন্তাবিদ, লেখিকা এবং আইনজীবী।

RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Most Popular

Recent Comments